৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মশা দিয়েই মশা নিধন

ব্যাপারটা অনেকটা কাঁটা দিয়ে তোলার মতো। মশা দিয়েই মশা নিধন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মানুষ যদি একবার অনুমতি দেয় তো ডেঙ্গুর মতো ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধে তাদের দেয়া হতে পারে ভিন্নধর্মী মশা-থেরাপি। একদল ব্রিটিশ গবেষক মশার কিছু জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছেন এবং দাবি করছেন পরিবর্তিত জিনের মশাগুলো মানুষকে কামড়ালে তারা রোগাক্রান্ত হবেন না উপরন্তু ঐ মশাগুলোর সঙ্গে সাধারণ মশার যৌনসংযোগ ঘটার পর সৃষ্ট নতুন লার্ভাগুলো ওড়ার আগেই সব কয়টি মারা পড়বে। ফলত মশার বংশবিস্তার পড়বে হুমকির মুখে। আর তখন সহজেই এড়ানো যাবে ফ্লোরিডার নব্য ত্রাস ডেঙ্গু ও চিকেনগুনিয়াসহ জটিলতর দূরারোগ্য ও যন্ত্রণাদায়ক তাবৎ মশাঘটিত রোগ।

ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সিটেকে গবেষকদের জিএমও ইনসেক্ট প্রজেক্টের আওতায় বানানো হয়েছে বিশেষ ঐ মিউট্যান্ট মশাগুলোকে। জিএমও এর পূর্ণরূপ জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড অর্গানিজম। জিনেটিক প্রকৌশলের চরম উৎকর্ষের এই একবিংশ শতাব্দিতে প্রকৃতির সূত্রকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতিকে বশে উপায় বের করছে বুদ্ধিমান মানুষ এটি যেমন সত্য, তেমনই সত্য মানুষ তার বুদ্ধি ও জ্ঞানের কালীক সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্টি করছে নতুন নতুন বিপদ। আরও গবেষণা করে জিনেটিক বৈশিষ্ট্য বদলে দেয়া ঐ ‘ভালো’ মশাগুলোকে হয়তো আসলেই নিরাপদ করা সম্ভব অথবা হতে পারে ওগুলো নিরাপদই বটে, কিন্তু মানুষ কী আর নিজের ওপর নিরীক্ষা করতে দিতে চায় এতো সহজে? change.org নামে সংগঠনের অনলাইন পাতা এরইমধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ফেলেছে যারা প্রয়োজনে ডেঙ্গুতে মরতে রাজি কিন্তু বাঁচার জন্যে নতুন ঐ মশার কামড় খেতে রাজি নন।

সমস্যা হচ্ছে ফ্লোরিডা মশাঘটিত অসুবিধায় ভুগছে নিদারুণ, এ অবস্থায় উভয় সংকটে পড়েছেন মশক দমন অধিদপ্তরের কর্তব্যরত কর্মকর্তারা। তাদেরই একজন মিশেল ডয়েল বলেন, ফ্লোরিডায় মশার উৎপাত যেভাবে বেড়েছে তাতে জিন বদলানো এ মশৌষধ (মশা+ঔষধ) কাজে আসতে পারে। কিন্তু মার্কিন খাবার ও ঔষধ সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী পরিষদ এর প্রয়োগের পক্ষে রায় দেয়ার আগে তা ফ্লোরিডায় ছাড়া যাবে না কোনোভাবেই।

mutant-mosquito-larva-on-oxitec-labফ্লোরিডা মেডিকেলের কীটতত্ত্ব বিভাগের আরেক গবেষক ফিল লুনিবসকেও পাওয়া গেল কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত। তিনি বলেন, বিজ্ঞান মশা মারতে কার্যকর কীটনাশক রাসায়নিক বানাতে পারে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ঐ জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড অর্গানিক মশাকে বলা যেতে পারে একটা কাঁটাযুক্ত প্রসঙ্গ, যেটিকে ঠিক নিশ্চয়তা সহকারে ধরা যাচ্ছে না, যেহেতু জনস্বাস্থের সঙ্গে বিষয়টি সরাসরি জড়িত।

অক্সিটেক বায়োটেকনোলজি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থায়ন পেয়ে থাকে। তারা এডিস মশার একটি বিশেষ প্রকরণ এডিস এজিপ্টিকে এই নতুন জিনেটিক মশা হিসেবে রূপায়িত করেছে। এ মশার জিনে পশে দেয়ার জন্যে তারা কৃত্রিম জিন তৈরি করেছে বিচিত্র সব প্রাণ ও উদ্ভিদ দেহ থেকে। হার্পিস সিপ্লেক্স ভাইরাস, ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া থেকে জীন নেয়া হয়েছে আরও নেয়া হয়েছে প্রবাল ও বাঁধাকপি থেকে। তারপর সংকর ঘটানো হয়েছে। নতুন কৃত্রিম জিনবিশিষ্ট এডিস মশাকে প্রায় সবরকম প্রাণির ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এবং দেখা গেছে প্রাণিদের ওপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। কিন্তু অপর কোন কীট বা পতঙ্গের ওপর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। কীট পতঙ্গগুলো মারা পড়েছে। গবেষকরা জিন বদলানো এডিসের স্ত্রী মশাগুলোকে আলাদ করে শুধুমাত্র পুরুষ মশাকে ‍মুক্ত করেছে। পুরুষ মশাগুলো সাধারণ এডিসের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছে। এবং নতুন এডিস শিশুগুলোর প্রতেকটি মারা গেছে লার্ভা অবস্থাতেই।

এভাবে বিবিধ উপায়ে নিরীক্ষার ফল ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রকৃতিতে নিহিত রহস্যময় বিজ্ঞান তো বিচিত্র উপায়ে নিজেরও পরিবর্তন ঘটায় যখন তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এখন না হয় সাধারণ স্ত্রী এডিস মশা ও জিন বদলানো পুরুষ এডিস মশার মিলনে আসা এডিস লার্ভা মারা পড়ছে। কিন্তু কালক্রমে বিবর্তনের সূত্র ধরেই লার্ভাগুলোর শরীরে স্বয়ংক্রীয় পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে এবং তখন তারা আর লার্ভা অবস্থায় মারা নাও পড়তে পারে। হয়ত আরও পরে পূর্ণাঙ্গ মশা হিসেবেই টিকে যাবে। তখন ঐ মিউট্যান্টদের সামাল দিতে কী আরও জটিল পথে ভাবতে গিয়ে আরও জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় না?

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ