২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রবীন্দ্র রচনায় ব্যক্তি – আত্নসম্বন্ধীয় : ইরানী বিশ্বাস

 বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে রবীন্দ্রনাথ এক অক্ষয় ও অবিম্মরনীয় নাম। রবীন্দ্রনাথের বাংলায় জন্মনিয়ে এবং বাংলাভাষী হিসাবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। এক জীবনে রবীন্দ্রনাথ যা লিখে গেছেন, বোধ করি এক জীবনে তার সব পড়ে আত্মস্থ করা কোন মানুষের পড়্গেই সম্ভব নয়। তবুও আমরা রবীন্দ্রনাথকে পড়ি। জনি তাঁর সম্পর্কে। জানার আগ্রহ মানুষের আজন্ম। তাই আমি এদিক থেকেও পিছিয়ে নেই। খুব ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ। তার ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক এ যেন আফিমের নেশার মতো পেয়ে বসতো। কতো বকুনি খেয়েছি। তবু তাঁকে ছাড়তে পারিনি। সেই আমি বয়স পেরিয়ে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। তবু কি তাকে বোঝা সম্ভব? বুঝতে আমি চাই-ও না। তাঁর উপন্যাসের হাত ধরে আমি শূন্যে ভাসি, কবিতায় গুনি ঢেউ, আর গানে বিভোর শ্রবণের অঝোর ধারার মতো। কারণ তাঁর সঙ্গে যে রয়েছে আত্মার সম্বÜ| রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা কিছু সম্বÜ পেয়েছি। সে বিষয়ে আমি সমান্য আলোকপাত করতে চেয়েছি।

‘ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বÜ এবং ব্যক্তির আত্মসম্বÜ-এই তিনটি উপন্যাসের বিষয়ভিত্তি। কবিতার সঙ্গে এর সম্বÜ শূন্য প্রায়’। রবীন্দ্রনাথ উক্ত ত্রয়ী সম্ব‡ÜiB অর্থতাৎপর্য সন্ধান করেছিলেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে বক্তির সঙ্গে সমাজের সম্বÜ, ‘ চোখের বালি’ তে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বÜ এবং ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে ব্যক্তির আত্মসম্বন্ধই প্রধান হয়ে উঠেছে।

‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের প্রেম, সৌন্দর্য ও জীবনচেতনার বহু বক্তব্যের সঙ্গে স্বীকৃত রবীন্দ্রনাথ যৌনতাকে অস্বীকার করেননি বরং তাকে স্থাপন করতে চেয়েছেন বৃহৎ জীবনের পটভূমিকায়। অবশ্য ‘চোখের বালি’ থেকেই মনসত্মত্ত্বসম্মত ঔপন্যাসিক প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। ‘চোখের বালি’র কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, এ উপন্যারে প্রথম বা সূচনা পর্বেই তলোয়ার খেলা স্পষ্ট। ‘চোখের বালি’র ভূমিকায় রবি ঠাকুর দাবি জানিয়েছিলেন, মানব বিধাতার এই নির্মম সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিবরণ তার পূর্বে গল্প অবলম্বন করে বাংলা ভাষায় প্রকাশ পায়নি। ‘চোখের বালি’ অসাধারণ উপন্যাস। কিন্তু মানব বিধাতার নির্মম সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রথম বাংলা উপন্যাসিক প্রকাশ ‘বিষবৃক্ষ’র পরবর্তী পদক্ষেপ মাত্র। এ উপন্যাসের অনত্মরে প্রবেশ করা মাত্র বুঝতে পারা যায়, মহেন্দ্র, বিহারী, আশা, বিনোদিনী, রাজলক্ষী, অন্নপূর্না এই প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে আকর্ষন-বিকর্ষনের খেলা আছে। এদের প্রত্যেকের জীবনই হয়ে উঠেছিল দ্বন্দময় ও সংরক্ত ও যন্ত্রণাবিদগ্ধ।

অনেকের ধারনা ‘নষ্ট নীড়’ এ অনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাবতরণ প্রায় ধাপে ধাপে উন্মোচিত হয়েছে। এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেবর-বৌদির মধ্যকার সম্পর্কের এক অবতারণ করেছেন। যা  নিষিদ্ধ পারিবারিক নর-নারীর সর্ম্পকের সমন্বয়ে মুক্তির পথ খুঁজে দিয়েছেন। অনেকের ধারনা এই মুক্তির পথ হয়তো কবির আত্মজীবনের সাথে কিঞ্চিত মিল আছে। ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর প্রতি কবির মুগ্ধতা। বলা যায় রবির প্রথম যৌবনে কড়া নেড়েছিলেন কাদম্বরী দেবীর প্রেম। কবির বিবাহের আগে পর্যন্ত এ প্রেম শুধু মাত্র বাৎসল্য প্রেম হিসাবে পরিগনিত হয়েছিল। তবে মৃনালিনী দেবীকে বিবাহ করে ঘরে তোলার কিছুদিন পর অনাকাঙ্খিত ভাবে কাদম্বরী দেবীর স্বেচ্ছামৃত্যু এসব ঘটনার সঙ্গে নষ্ট নীড় এর আখ্যান প্রায় সমানত্মরাল। তবে ‘নষ্টনীড়’-এ ব্যক্তির টানাপোড়েনের সূচনা পর্বেই পর্দা টেনে দিয়েছিলেন রবী ঠাকুর।

বাংলা উপন্যাসের এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে ‘শেষের কবিতা’। এ উপন্যাসের লাবন্য ও অমিত চরিত্র দুটি প্রথম যৌবনের যুবক-যুবতিদের প্রত্যেকের খুব চেনা। জানা যায়, এ উপন্যাস লেখার ৫ বছর আগে রবি ঠাকুর শিলং পাহাড়ে একবার এসেছিলেন। তখন বাষট্টি বছরের নির্জলা যৌবনের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ শিলং পাহাড়ে তার সৃষ্ট অমিতের মতোই ভ্রমন করেছিলেন। ইউক্যালিপটাস ও পাইন বনের সুগন্ধী বাতাস গায়ে মেখে এক সপ্তদশী সুন্দরী রাণু দেবীকে সঙ্গে নিয়ে হাস্য-কৌতুকে মজে ছিলেন। শেষের কবিতা উপন্যাসেও আমরা দেখতে পাই একদিন এই শৈলাবাসেই হঠাৎ করে এক পাহাড়ের বাঁকে দুটি গাড়ির দৈবক্রমে আপঘাত না-ঘটা, মুখোমুখি আঘাতে অমিত ও লাবন্যর সাড়্গাৎ এবং তা থেকেই পরিণতি ঘটে আশ্চর্য সুন্দর রোমান্টিক প্রেমের।

উপন্যাসের স্রষ্টার সঙ্গেই শুধু তার সৃষ্টি অমিত’র মিল নয়, রাণু আর লাবণ্যতেও রয়েছে অনেক মিল। যে জায়গায় দুজনের সবচেয়ে বড় মিল তা হল উভয়েরই রবি ঠাকুরের প্রতি গভীরতম অনুরাগ। শেষের কবিতা লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, লাবণ্য তার খুব চেনা। কিন্তু রাণু-রবীন্দ্র নাথের পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্কটি অমিত-লাবণ্যর মতো অমন সল্প পরিসর সংকিপ্ত ছিল না। বরং বলা যায়, সে সম্পর্ক যথেষ্টই দীর্ঘ। অনিকদিন ধরে একটু একটু করে গড়ে ওঠা মধুর, বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক। অমিত-লাবন্যর প্রেমের ড়্গেত্রে আমরা শুধু মনসত্মাত্ত্বিক সম্বÜ দেখতে পাই। তাই তো অমিত আস্ফালন করে বলেছিল, তার প্রেমের সত্যে কেতকীও থাকবে আবার শোভনলালের স্ত্রী লাবণ্য দেবীও হারিয়ে যাবার নয়। অর্থাৎ অমিত ঘড়ায় তোলা জল ব্যবহার করবে, আবার দিঘীতে সাঁতার কাটবে।

আবার অন্য দিকে দেখতে পাই, ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে অনত্মলোকের চেয়ে বহির্লোকের আলোচনা বেশি। এখানে অতীনের কাছে এলার আবেদন ছিল শুধু প্রেম নয়। এখানে প্রেমের চেয়ে দেহ ছিল অগ্রাধিকার। তাই তো এলা কাম চেয়েছিল অতীনের কাছে।

 হিন্দু নর-নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্ক রবি মানসে কোথাও হয়তো ব্যথিত করেছে। যা বার বার উপন্যাসের মাধ্যমে মুক্তির খোঁজ করেছে। যদি ‘চোখের বালি’-তে দেখি, সেখানে তিনি দেহজ বাসনাকে একটি নগ্নতায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে শ্যালিকা-ভগ্নিপতির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এ উপন্যাসটির উপসংহার আকস্মিকভাবে। অনেকটা ছোটগল্পের মতোই। কিন্তু ঐ আকস্মিকতা সম্পূর্ন রকমে মনসত্মত্ত্বসম্মত। নীরজার সেই আকস্মিক আতীব্র চিৎকার এক মূহুর্তে তার চরিত্রের গভীর গোপনতম প্রদেশ পর্যন্ত তীব্র আলোয় ভরে ফেলেছিল। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ অনেকটাই ব্যাক্তিস্বান্ত্র্যে প্রতিভাস, আত্মসর্বস্ব চিন্তায় উৎকেন্দ্রিক। তৎকালিন স্বদেশী আন্দোলনের ভাবাবেগের কড়ামদের ফেনিল আবেশে সে উন্মত্ত নয়। তার নিঃসঙ্গ ধ্যান-ধারণা ও পরিবারের প্রতি নির্লিপ্ততা অনেকটাই যেন সমাজ বিচ্যুত। নিখিলেশ মৌলভিত্তিক মানবিক ও সামাজিক এবং সে আবেগ ও সংস্কারের আবর্তে আবসিত নয়- বরং সে সংযত সংহত ও তার অনত্মর মানস শিল্প সংযতের আবহে আভাসিত। সন্দীপ চরিত্র অঙ্কনে, রবীন্দ্রনাথ নিজের ইচ্ছাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন। অসহ্য বেদনা বোধ ও আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত এবং অনর্ত্মলোক ও বহির্লোকের জটিল আবর্তে বিমলা এক উজ্জ্বল চরিত্র।

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে দামিনীর দুরনত্ম বাসনার আশ্চর্য প্রকাশ। (তারপর কিসে আমার পা জড়াইয়া ধরিল। প্রথমে ভাবিলাম কোন একটি বুনো জন্তু। কিন্তু তাহাদের গায়ে তো রোঁওয়া আছে,এর রোঁওয়া নেই। আমার সমসত্ম  শরীর যেন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। মনে হইল একি সাপের মতো জন্তু, তাহাকে চিনি না। তার কি রকম মুখ, কি রকম গা, কি রকম লেজ কিছু্‌ জানা নাই- তার গ্রাস করিবার প্রণালীটা কি ভাবিয়া পাইলাম না। সে এমন নরম বলিয়াই এমন বীভৎস সেই ক্ষুধার পুঞ্জ)। ‘চতুরঙ্গ’ আপাদমসত্মক একটি দ্বন্দারক্ত উপন্যাস এতে সন্দেহ নেই। শচীশ ও দামিনীর সম্পর্কে যেন প্রথম থেকেই আগুন ধরে ছিল। পরবর্তীতে সমসত্ম উপন্যাসব্যাপী সেই অগ্নিলীলা ছড়িয়ে পড়েছিল। শচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাসের চরিত্রপাত্রের আকর্ষন-বিকর্ষণের তীব্র দোলাজচল টান করে রেখেছে সমসত্ম উপন্যাসটিকে।

‘রাজর্ষি’ ই প্রথম স্বার্থক উপন্যাসের আকারে দানা বেঁধে ওঠেছে। এই প্রথম আমরা রবী উপন্যাসে আনত্মঃপ্রকৃতি আর বহিঃপ্রকৃতির তীব্র স্পন্দন অনুভব করি। এখানেই তিনি মানব মনের জটিল গ্রন্থি ও অনত্মর্লোকের দুর্গম পথে প্রবেশ করার কপাট খুলে দিয়েছেন এবং মানব মনের অনত্মর্লীন রহস্যের চিত্র উম্মোচোনের চেষ্টাও আভাসিত হয়েছে। তবে এখানে অরো একটি কথা মনে রাখতে হবে, এখানে কাহিনী বুননের গতিহারা শৈথিল্য এবং তত্ত্বপ্রচারের ভার যেন আমাদের আহত করে। কাহিনী চরিত্র ও ঔপন্যাসোচিত ঔচিত্যের চেয়ে প্রেমের কাছে প্রতাপের পরাভব এই আদর্শ ও তত্ত্ব প্রচারই যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। যদিও দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের তীব্রতা চরিত্রগুলো মর্মভেদী যন্ত্রনা ও শিল্পরূপের ঔজ্জ্বল্যে প্রখর।

তখনকার সময়ে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি ছিল অনেকটা আধুনিক। এখানে রয়েছে মনসত্মত্ত্বিক বিশেস্নষণের গভীরতা এবং চরিত্রগুলোর অনত্মর্লোক উদঘাটনের উজ্জ্বলতা। এ প্রসঙ্গে রবি ঠাকুর বলেছেন, পুরম্নষের কর্ম পথে এখনও সন্ধান চেষ্টার শেষ হয়নি। কোনো কালেই হবে না। অজানার মধ্যে কেবলই সে পথ খনন করেছে। কোনো পরিণামে এসে আজও সে অবকাশ পেলে না। পুরম্নষের অসম্পূর্ন থাকতে হবে।এই ভাবে রবীন্দ্র উপন্যাস মননশীলিত হয়েছে। কিন্তু হৃদয়কে বাদ দিয়ে নয়। তবে অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ সব লেখাতে জাগতিক প্রেমে আস্বাদিত ছিলেন না। তিনি সব সময় ঐশ্বরিক প্রেমে নিমগ্ন ছিলেন।

এবার কবিতার কথায় আসা যাক। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মানবপ্রেমের প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অনেকেই তা মানতে নারাজ। তাদের ধারনা কবি ছিলেন ঐশ্বরিক সাধনায় নিমগ্ন। তাই ঈশ্বর ভক্তিরস ছাড়া তিনি অন্য কিছুই লিখতেন না। যদি উদাহরন রূপে ভগ্ন হৃদয় কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন ধরে বলতে পারি,

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রম্নবতারা।

এ সমুদ্রে আর কভূ হব নাক পথ হারা

সেথা আমি যাইনাকো, তুমি প্রকাশিত থাকো।

আকুর এ আখি পরে ঢাল গো আলোকধারা

ও মুখখানি সদা মনে জতিতেছে সঙ্গেপনে

আধার হৃদয় মাঝে দেবীল প্রতিমা পারা

গীতবিতানে এই গানটি ব্রক্ষ্মসঙ্গীত হিসাবে বলা হয়েছে। মানুষ মূলত দেহবাদী- আধ্যাত্মবাদী নয়। হতাশা ব্যার্থতা শূন্যতা ও রিক্ততা এবং ণৈরাশ্য ও পরাজয়ের ফলে মানুষ নিজেকে ভাববাদী ও আধ্যাত্মবাদি বলে জাহির করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে এ কবিতা লিখেছেন তখন বয়স খুবই কম। যৌবনের পুরোটা সময় জুড়ে নিশ্চয়ই তিনি ভাববাদ লিখবেন না!

রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, ভগ্নহৃদয় লিখতে আরম্ভ করেছিলাম তখন আমার বয়স আঠারো। বাল্যও নয়, যৌবনও নয়। বয়সটা এমন একটা সন্ধিস্থলে যেখান থেকে সত্যের আলো স্পষ্ট পাবার সুবিধা নেই। একটু একটু আভাস পাওয় যায় এবং খানিকটা ছায়ার মতো।

 উপহারের আরো একটি কবিতা ‘শ্রীমতি হে..’ থেকে কয়েকটি লাইন ধরে বলা যায়,

হৃদয়ের বনে বনে সূর্য্যমুখী শত শত

ওই মুখপানে চেয়ে ফুটিয়ে উঠেছে যত।

বেচে থাকে বেচে থাক শুকায় শুকায় যাক্‌

ওই মুখপানে তারা চাহিয়া থাকিতে চায়।

উপহার পর্বেও এই ‘শ্রীমতি হে..’ আসলে কে, এ প্রসঙ্গে কোন নাম উলেস্নখ নেই। অথচ তাকে নিবেদন করে কবির লেখা এত প্রেমময় একটি কবিতা লিখেছেন। প্রশ্ন আসতেই পারে মনে। এ বিষয়ে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়

 আমি ইন্দিরা দেবীর নিকট শুনিয়াছি, ‘হে-’ মুলত কাদম্বরী দেবীর ছদ্ম নামের অদ্যাক্ষর। তাহার ডাকনাম ছিল ‘হেকেটি’। ইনি প্রচীন গ্রিকদের ত্রিমুন্ডী দেবী। অনত্মরঙ্গেরা রহস্যাচ্ছলে এই নামটিতে ডাকতেন। কাদম্বরী দেবীর নারীহৃদয় ত্রিবেণীসংগমক্ষেত্র ছিল। কবি বিহারীলালকে শ্রদ্ধা, স্বামী জৌতিরিন্দ্রনাথকে প্রীতি ও দেবর রীবন্দ্রনাথকে স্নেহ দ্বারা তিনি আপরার করিয়া রাখিয়াছিলেন। সেই জন্য অনত্মরঙ্গ আত্ময়য়রা বলিতেন ত্রিমুন্ডী ‘হেকটি’। এই নারীর স্নেহ ও শাসন রবীন্দ্রনাথের যৌবনকে সুন্দরের পথে চালিত করিয়াছিল এবং পরবর্তীকালে তাহারই পবিত্র স্মৃতি ছিল তাহার জীবনের ধ্রম্নবতারা।

কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কটি যতোই শারীরিক গন্ধবিহীন বলা হোক এবং কাদম্বরী যতোই দেবী স্থানীয়া, মাতৃ আসনে অধিষ্ঠিত করা হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতার লাইনে সে ঘ্রান প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র চৌদ্দ বছরের বালক রবীন্দ্রনাথ ভরা যৌবনাবতি কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে কাম গন্ধহীন ঐশ্বরিক খেলায় মেতে উঠবে, এটা অবিশ্বাস্য।

অনত্মর কেবল

অঙ্গের সীমানত্মপ্রানেত্ম উদ্ভাসিয়া উঠে

এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটি।

চুম্বন মাগিব যবে ঈষৎ হাসিয়া

বাকায়োনা গী্রবাখানি, ফিরায়োনা মুখ,

উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণ সুধাপূর্ন সুখ

রেখো ওষ্ঠাধর পুটে- ভক্তভৃঙ্গ তার

সম্পূর্ন চুম্বন এক হাসি স্তরে

সরস সুন্দর।

আবার , ‘আকাশভরা তারার মাঝে আমার তারা কই?’

এই তারা ও সমসত্ম উপমা সবই Kv`¤^ix| ছায়ার মতো এই তার রবীন্দ্রমানসকে আলোড়িত করেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সকল উপমা কাদম্বরীকে উদ্দেশ্য করে।

নাহি জানি, কেহ নাহি জানে

তবু সুর বাজে মোর গানে

কবির অনত্মরে তুমি কবি,

নও ছবি নও ছবি নও শুধু ছবি

তোমারে পেয়েছি কোন প্রাতে

তারপরে হারায়েছি রাতে।

তারপরে অন্ধকারে অগোচরে তোমারেই লভি।

নও ছবি নও তুমি ছবি।

রবীন্দ্রনাথ ব্যরিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত যাবার সব রকম প্রস্তুতি স্থির। এ সময় কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিলেত যাত্রা স্থগিত করা হলো। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি। কিন্তু বিবাহ সম্পন্ন হবার কিছুদিন পর কাদম্বরী চির দিনের জন্য বিদায় নিলেন পৃথিবী ছেড়ে।

জীবনের প্রথম থেকে শেষ পযন্ত বহু নারীর সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছে। তাদের সাথে মানবিক প্রেম থেকে শারীরিক প্রেম সব ঘটনাই ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ একজন মহৎ কবি এটা অনস্বিকার্য  কিন্তু তিনি একজন মানুষ হিসাবে তাঁর দৈহিক চাহিদা ও জৈবিক চাহিদা ছিলো না এটা বলা যাবে না। । – ইরানী বিশ্বাস

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ