[english_date]

ভয়েস নকল করে ধোঁকাবাজির শুরু সেই আফগান যুদ্ধেই

ইদানীং ভয়েজ মেসেজ ও ভয়েস ভেরিফিকেশন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো. এমনকী প্রতারণার খবর পর্যন্ত মিলছে৷ এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশের পক্ষ থেকে এর মধ্যে একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছে৷ এখন তথ্যপ্রযুক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী ও উন্নত, তাতে যেমন মানুষের প্রচুর লাভও হয়েছে, ঠিক তেমনই তার হাত ধরে সন্ত্রাস এবং প্রতারণার জালও নানা ফন্দিফিকির বের করে সমাজ তথা প্রশাসনকে নিত্যনতুন বিপদে ফেলছে৷

ইন্টারনেট ও অন-লাইনের মাধ্যমে ভয়েসের চাতুরিতে জঙ্গি চক্রান্ত সহ নানা ধরনের দুষ্কর্ম ও ধোঁকাবাজির যেসব নমুনা হালে মিলছে, তার সূত্র কিন্তু ঘুরেফিরে পৌঁছাচ্ছে সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে৷ বিশেষ করে, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ফৌজ ঢোকার পর তাদের মোকাবিলায় আমেরিকার নেতৃত্বে কট্টর মুসলিম সন্ত্রাসবাদে মদতদানের যে অভিযান সেখানে শুরু হয়, তখনই এর সূত্রপাত৷ আর তাতে যোগ দিয়েছিল কমিউনিস্ট চীন থেকে ইজরায়েল সকলেই৷ তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ ক্রেমলিনকে শায়েস্তা করা৷

লাল সোভিয়েতের মোকাবিলায় লাল চীনের সঙ্গে আমেরিকার রণনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেজিংয়ের ক্ষমতায় দেং শিয়াও পিং বসার আগেই৷ আর এর জন্য মার্কিন কর্তাদের আস্থাভাজন হিসাবে জমিটা গড়েপিটে দিয়েছিলেন চীনা ইন্টেলিজেন্সের সর্বেসর্বা তথা মাও-সে-তুং ও মাদাম মাওয়ের সব চাইতে কাছের লোক কাং শেং৷ আফগানিস্তান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ কমিউনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে গোপন অভিযানে নেমে আমেরিকা তথা ন্যাটো জোট তখন এমন একটা জায়গা খুঁজছে, যেখান থেকে তারা রুশ বাহিনীর যাবতীয় গতিবিধির উপর, বিশেষ করে তাদের রেডিও মেসেজের উপর আড়ি পাততে পারবে এবং সেগুলি আফগান মুজাহিদ তথা কট্টরপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের সময়মতো সরবরাহ করতে পারবে৷ চীনের শিনকিয়াং প্রদেশেই তারা সেই পছন্দসই জায়গাটি খুঁজে পায়৷ একই সময়ে তাদের হাতে আসে এক অসাধারণ প্রযুক্তি৷ ইজরায়েলের তুখোড় বিশেষজ্ঞদের তৈরি সিগন্যালিং ইন্টেলিজেন্সের (সিগইনট) সেই প্রযুক্তির সাহায্যে কেবল প্রতিপক্ষের রেডিও মেসেজের পাঠোদ্ধার নয়, চাইলে তা জ্যাম করে দিয়ে অবিকল কণ্ঠস্বর ও ভাষা নকল করে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে দেওয়াও সম্ভবপর ছিল৷ এই প্রযুক্তির নাম ছিল ‘সেরবেরাস’৷ অর্থাৎ, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী পাতালের প্রহরী সেই তিন মাথাওয়ালা কুকুর৷ যার মুখ থেকে আগুন বের হত এবং যাকে কাবু করে তাঁর শেষ ক়তিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ হারকিউলিস৷ সেই ‘সেরবেরাসে’র নামেই ইজরায়েল তাদের উদ্ভাবিত এই নতুন প্রযুক্তির নামকরণ করে৷

১৯৬৭ সালে মিশরের সঙ্গে যখন যুদ্ধ বেধেছিল তখন এই প্রযুক্তিকে প্রথম কাজে লাগায় ইজরায়েলের গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ৷ ‘সেরবেরাসে’র সাহায্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের ও জর্ডনের রাজা হুসেনের টেলি-কথোপকথন ট্যাপ করে তারা শুধু তাতে বিভ্রাট ঘটায়নি, কণ্ঠস্বর নকল করে দুই রাষ্ট্রপ্রধানকেই ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছিল৷ একইভাবে নাকের জলে চোখের জলে করে ছেড়েছিল আরব মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্সকে৷ ১৯৭০-এর দশকে ঠান্ডা যুদ্ধ যখন পুরোদমে, তখন ইজরায়েলের মোসাদের কাছে এই প্রযুক্তি চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির গোয়েন্দা বিভাগ ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা বিএনডি৷ মোসাদ তাদের হাতে উন্নততর ‘সেরবেরাস’ তুলে দেয়৷ তা কাজে লাগিয়ে বিএনডি ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার ওয়ারশ জোটকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিল৷ আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা রুশ ফৌজের মোকাবিলায় পশ্চিম জার্মানির গোয়েন্দা বিভাগের সৌজন্যে ইজরায়েল থেকে এল আরও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘সেরবেরাস’৷ আফগানিস্তান লাগোয়া চীনা ভূখণ্ডে বসানো হল তা৷ রুশ ফৌজকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভয়েস ধোঁকাবাজির এই অভিযানের নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন পামির’৷

আফগানিস্তানের মাটিতে রুশ ফৌজকে কাবু করার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়া, ইজরায়েল, লাল চীন এবং সেইসঙ্গে পাকিস্তান সহ ইরান ও সৌদি আরবের যে ‘মহাজোট’ সেদিন জন্ম নিয়েছিল, সেই দুষ্টচক্রের বিষময় ফল আজও গোটা বিশ্ব বয়ে চলেছে৷ নানা রূপে শয়তানির নয়া নয়া আবির্ভাব ঘটছে৷ লাদেন থেকে আজকের আই এস, সবই তার চেন রিঅ্যাকশন৷ ঠিক একইভাবে, গোটা বিশ্বের জনজীবনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভয়েস মেল বা ভয়েস মেসেজের যে হারাকিরি হাঙ্গামা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের আজ এত মাথাব্যথা, তারও গোড়াপত্তন ঘটেছিল আফগানিস্তানের মাটিতে, সেই রুশবিরোধী গোপন চক্রান্তের হাত ধরেই৷ মার্কিন প্রশাসন, লাল চীন কিংবা ইজরায়েল, কেউই সেটা অস্বীকার করতে পারে কি?

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ