‘আমাকে আমার ক্ষমতার জন্য জানুন, আমার অক্ষমতার জন্য নয়’– রবার্ট এম হেন্সেল
আজ ৩ ডিসেম্বর, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস। প্রতি বছর এই দিবস পালনের উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ দিবসের ঘোষণা করে। এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো প্রতিবন্ধীতার বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদার অধিকার এবং সম্পূর্ণ মঙ্গল নিশ্চিতকরণ।
অক্ষমতা কী?
অক্ষমতা শারীরিক বা মানসিক এমন একটি অবস্থা, যা মানুষের নির্দিষ্ট কিছু কাজে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। এই সীমাবদ্ধতা নিজের সঙ্গে নিজের, নিজের সঙ্গে অন্যের এবং নিজের সঙ্গে চারপাশের পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তৃত।
চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে দীর্ঘায়িত করছে। ফলে বাত, পেশি ও হাড়ের ব্যাধি দীর্ঘ জীবনের জন্য একটি অভিশাপ বয়ে আনছে। ফলে একজন সুস্থ মানুষও কিন্তু একটি সময়ের পর অক্ষম হয়ে যেতে পারেন।
প্রকাশ্য অক্ষমতা যত সহজে চিহ্নিত করা যায়, লুকায়িত অক্ষমতা চিহ্নিত করা আরো কঠিন।
প্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া প্রয়োজনপ্রতিবন্ধী শিশুর সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া প্রয়োজন
লুকানো অক্ষমতা কী?
শেখার অক্ষমতা, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সম্পৃক্ত যেমন: অটিজম, এডিএইচডি (অস্থির আচরণ) এবং মানসিক রোগজনিত অক্ষমতা ইত্যাদি লুকানো অক্ষমতা কারণ। এসব ব্যাধির সুনির্দিষ্ট শারীরিক লক্ষণ সব সময় বোঝা যায় না। গবেষণালব্ধ উপাত্ত বলছে, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধীতা অদৃশ্য।
অক্ষমতার সামাজিক মডেল কী?
প্রতিবন্ধিতা আসলে ব্যক্তির পছন্দের জীবনকে সীমাবদ্ধ করার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সমাজ দ্বারা পরিচালিত। এই বাধাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং অপসারণের উপায়গুলো সমাধান করা গেলেই অক্ষমতা কমে যাবে। সমাজ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পছন্দের পরিসরকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলে। ফলেই বাধাগুলো সরিয়ে ফেললেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বাধীন এবং সমাজে আর দশজনের মতো নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন।
প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
আসলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাধা শুধু দৈহিক নয়। সমাজে তৈরি কুসংস্কার, প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস, অনাদিকাল থেকে প্রচলিত ধারণাগুলো কিন্তু অক্ষমতা। আর এই অক্ষমতা বহন করে সমাজের তথাকথিত সুস্থ মানুষ। কাজেই সুস্থ মানুষ যতদিন ভাববেন, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সমান সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নন, ততদিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে না।
দ্য ইন্ডিভিজুয়াল উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি এডুকেশন অ্যাক্ট মোটা দাগে ১৪ ধরনের অক্ষমতাকে এখন পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে। যেমন: ১. অটিজম ২. অন্ধত্ব ৩. বধিরতা ৪. মানসিক অশান্তি ৫. শ্রবণ প্রতিবন্ধী ৬. বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা ৭. একাধিক অক্ষমতা ৮. হাড় এবং পেশীজনিত দুর্বলতা ৯. অন্যান্য স্বাস্থ্যজনিত দুর্বলতা ১০. শেখার অক্ষমতা ১১. কথা বলার দুর্বলতা ১২. মস্তিষ্কের আঘাতজনিত অক্ষমতা ১৩. দৃষ্টিহীনতা ১৪. বেড়ে ওঠার শ্লথগতি।
কিন্তু এই তালিকা আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য।
কড়াইল বস্তিতে শারীরিক ও মানসিক শিশু প্রতিবন্ধীকড়াইল বস্তিতে শারীরিক ও মানসিক শিশু প্রতিবন্ধী। অক্ষমতার মেডিকেল মডেল কী
অক্ষমতার মেডিকেল মডেল বলে, মানুষ তার প্রতিবন্ধকতা দ্বারা অক্ষম। কাজেই এই বৈকল্য বা পার্থক্যগুলোকে নির্দিষ্ট করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ফলে মেডিকেল মডেল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে কী ভুল করা হচ্ছে শুধু সেটা দেখে, কিন্তু মানুষটির কী প্রয়োজন সেটা দেখে না। ফলে সম্পূর্ণ মানুষটির নিজস্ব স্বাধীনতা, পছন্দ, নিজের জীবনটিকে নিজের মতন করে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গাটি এখানে স্পর্শ করা হয় না। এখানে শুধু মানুষটির শারীরিক স্বাস্থ্যই বিশাল ক্যানভাস হিসেবে ধরা পড়ে। সেখানে মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের স্বীকৃতি থাকে না।
একটু খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের দেশে বাসে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী উঠতে পারেন কিনা? কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী স্বচ্ছন্দে শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন কিনা?
আসলেই কি আমি হুইলচেয়ারে বসে বাথরুমটি পর্যন্ত যেতে পারি? অথবা বাস পর্যন্ত উঠতে পারি? কিংবা আজকে আমার শপিং করতে ইচ্ছা করছে শপিং মলের সর্বোচ্চ তালায় উঠে ইচ্ছামতো উইন্ডো শপিং করতে পারি? নাকি সিনেমা হলে বসে পছন্দের সিনেমাটি দেখতে পারি?
আমার একজন ভিনদেশি সুপারভাইজার ছিলেন, যিনি ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত। ভদ্রলোক চমৎকার পড়াতেন। তিনি আমার খাতা বা নোট কারেকশন করতে পারতেন না। আমি অনেক কিছু শিখেছি এই মানুষটির কাছ থেকে।
কিন্তু একটু চিন্তা করুন তো, বাংলাদেশে একজন ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি, যার সমস্ত বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ন তিনি কি নিজ বাড়িতে স্বাধীনভাবে মেডিকেল মডেলের অধীনে বাস করতে পারবেন? পারবেন না কারণ তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম। অথচ তার বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতা আমার সেই সুপারভাইজার এর মতন আর দশ জনের থেকে অনেকাংশেই বেশি হতে পারে।
তাহলে অক্ষমতার সমাধান কী?
বিশ্বে সামাজিক মডেল বনাম অক্ষমতার মেডিকেল মডেল ছাড়া বাস্তব উপযোগী কোনো মডেল এখনো গড়ে ওঠেনি। কারণ অক্ষমতার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি যত্নের। যতদিন পর্যন্ত না চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলো এই দীর্ঘমেয়াদি যত্ন সুনিশ্চিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই বোঝাটি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ঘাড়ে বইতে হবে।
মানুষের জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। স্কট হ্যামিলটনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভাবনার জায়গায় শুধু একটা কথাই অনুরণন তুলুক, ‘জীবনের একমাত্র অক্ষমতা হলো একটি খারাপ মনোভাব।
লুই ব্রেইল চমৎকার বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই সমান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা এটি আনতে পারি।
প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে যে ৩টি বিষয় সবার জানা প্রয়োজনপ্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে যে ৩টি বিষয় সবার জানা প্রয়োজন
আশা করি, এই যোগাযোগের মাধ্যম শুধু একটি দিবসের সীমাবদ্ধ থাকবে না। কারণ আগামীতে এই অক্ষমতায় আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বা আমার পরিবারের অনাগত কেউ আক্রান্ত হতে পারে। আজ যদি সচেতন না হই সেদিন আমরা কীভাবে সামাল দেব?
শুধু একটি কথা মনে রাখলেই যথেষ্ট, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঠিক আপনার আমার মতই আরেকজন ব্যক্তি। সেই ব্যক্তি হওয়ার মর্যাদাটুকু আমরা যেন শুধু কাগজে-কলমে নয় প্রাত্যহিক আচরণে দিই।