২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এবার শিক্ষিকাকে ধর্ষনের হুমকি।

ভারতের পথসভায় নেতা বলেছিলেন ‘রেপ করিয়ে দেব’। এ বার সেই দলেরই ছাত্রনেতা একই হুমকি দিলেন শিক্ষিকাদের। বলে দিলেন, ‘রেপ করিয়ে দেব’।

লোকসভা নির্বাচনের মুখে কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল নদিয়ার নাকাশিপাড়ার চৌমুহাতে ভোটের প্রচারে গিয়ে বিরোধীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব।’ বুধবার মালদহের সামসি কলেজের দুই শিক্ষিকাকে একই ভাষায় হুমকি দিলেন ওই কলেজের তৃণমূল ছাত্র নেতা তাজামুল হক। অভিযোগ, ওই দুই শিক্ষিকাকে ছাদ থেকে ফেলে খুনের হুমকিও দিয়েছেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাজামুলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। জামিন অযোগ্য ধারায় মামলাও হয়েছে। তাজামুল অবশ্য পলাতক।

তাজামুল সামসি কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজের ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-র। তাজামুল ছাত্র সংসদের সংস্কৃতি সম্পাদক। ঘটনার দিন কলেজে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা ছিল। সামসি কলেজে আসন পড়েছিল হরিশ্চন্দ্রপুর কলেজের পড়ুয়াদের। সাত নম্বর ঘরের পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন সংস্কৃত ও সমাজবিদ্যার আংশিক সময়ের দুই শিক্ষিকা। পরীক্ষা শুরুর ১৫ মিনিট আগে তাঁরা পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখেন, বারমুডা আর টি শার্ট পরে মদ্যপ অবস্থায় সঙ্গীদের নিয়ে ভিতরে ঘোরাঘুরি করছেন তাজামুল। দুই শিক্ষিকা হলে ঢুকতেই তাঁদের উদ্দেশে তাজামুল কটূক্তি করতে শুরু করেন বলে অভিযোগ। শিক্ষিকারা তাঁকে সঙ্গীদের নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যেতে বললে তিনি তর্ক জুড়ে দেন। তখন শিক্ষিকারা তাঁকে বলেন, নিজে থেকে না বেরোলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাঁকে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বার করে দেওয়া হবে। অভিযোগ, এর পরেই তাজামুলকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘তোদের রেপ করিয়ে দেব, ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব!’ হইচই শুনে শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহ অশিক্ষক কর্মীরাও ছুটে আসেন। তাঁদেরও হুমকি দেন তাজামুল। তার পরে তাজামুলকে বাইরে বার করে দিয়ে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরে সুষ্ঠু ভাবেই পরীক্ষা শেষ হয়।

কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে ফের কলেজে ঢুকে পড়েন তাজামুল। সরাসরি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোজ ভোজের ঘরে ঢুকে দুই শিক্ষিকাকে ডেকে পাঠিয়ে ‘বিচার করতে হবে’ বলে হম্বিতম্বি শুরু করেন। মনোজবাবু তৃণমূলের জেলা শিক্ষা সেলের আহ্বায়ক। মনোজবাবুর সঙ্গে তাজামুলের খানিকক্ষণ তর্কাতর্কি হয়। কিছু ক্ষণ পরে তাজামুল কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে যান।

শিক্ষকেরা এর পরে মনোজবাবুকে লিখিত ভাবে জানান, পুলিশে অভিযোগ জানাতে হবে। তাজামুলকে বহিষ্কারও করতে হবে। শিক্ষকেরা মনোজবাবুকে জানিয়ে দেয়, তাঁদের দাবি মানা না হলে তাঁরা আর পরীক্ষা নেবেন না। রাতেই মনোজবাবু কলেজের কয়েক জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীকে নিয়ে কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি অম্লান ভাদুড়ির বাড়ি যান। অম্লানবাবু ইংরেজবাজার পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও। ঘটনাচক্রে, যে দুই শিক্ষিকাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁরাও ওই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা। অম্লানবাবুর বাড়িতেই সিদ্ধান্ত হয়, তাজামুলের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানানো হবে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে চাঁচল থানায় সেই অভিযোগ দায়ের হয়েছে। মনোজবাবু বলেন, ‘‘অভিযোগ জানানো হয়েছে। তাজামুলকে বহিষ্কার করা হবে কি না, পরিচালন সমিতি সিদ্ধান্ত নেবে।’’

গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সমূহের নিয়ামক সনাতন দাস জানান, প্রশাসনিক স্তরে যা ব্যবস্থা নেওয়ার, সবই নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘পরীক্ষার হলে এই ঘটনা বরদাস্ত করা যায় না। জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসনকেও সব জানিয়েছি। ওই কলেজে সুষ্ঠু ভাবে পরীক্ষা চালাতে যা যা করা দরকার, সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।’’ মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।

চৌমুহার সভায় ‘রেপ করিয়ে দেব’ হুমকির পরে তাপস পালের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়েছে। কিন্তু তৃণমূল দলগত ভাবে তাপসবাবুর বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাজামুলের ক্ষেত্রে অবশ্য দল ব্যবস্থা নিতে পারে বলে ইঙ্গিত। জেলা তৃণমূলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘‘শিক্ষাঙ্গনে এমন আচরণ বরদাস্ত করা হবে না।’’ তিনি জানান, রতুয়া ব্লক সভাপতিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছেন। কিন্তু তাজামুল কি তাপসবাবুর কথাতেই প্রভাবিত হয়ে এই মন্তব্য করেছেন? মোয়াজ্জেমের বক্তব্য, ‘‘তাপসবাবু কী বলেছেন না
বলেছেন, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।’’

কৃষিজীবী বাবার একমাত্র সন্তান তাজামুল সম্পর্কে কলেজের টিএমসিপি নেতৃত্বের ধারণাও অবশ্য ভাল নয়। কলেজের ছাত্র সংসদের সম্পাদক মহম্মদ জিয়াউল হক বলেন, ‘‘সব জানি। কিন্তু আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগেও মদ খেয়ে কলেজে ঢোকার জন্য দলের নেতাদের কাছেই ভর্ৎসিত হয়েছিলেন তাজামুল।

তাজামুলের অবশ্য দাবি, সামান্য ঘটনাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন হল-এ ছিলাম, তখন পরীক্ষা শুরুই হয়নি। কিন্তু ম্যাডাম আমাকে খারাপ ভাষায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়ার কথা বলায় আমি বলেছিলাম, বার করে দেখান তো! এর বেশি কিছু হয়নি।’’

দুই শিক্ষিকাই একযোগে বলেন, ‘‘যা বলার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জানিয়েছি।’’ কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের বক্তব্য, প্রকাশ্যে সবার সামনে যে ভাবে দুই শিক্ষিকাকে হুমকি দিয়ে নোংরা কথা বলা হয়েছে, তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় মালতিপুরের আরএসপি বিধায়ক আব্দুর রহিম বক্সি বলেন, ‘‘সাংসদ যেখানে লোক দিয়ে রেপ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে পার পেয়ে যান, সেখানে ওই দলের নেতাদের কাছে আর বেশি কি আশা করা যায়!’’ তিনি জানান, তাজামুলের বিরুদ্ধে তৃণমূল কী ব্যবস্থা নেয়, তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন এলাকার মানুষ।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ