ভারতে দিল্লির নিজামউদ্দিন কান্ডে সমালোচিত তাবলীগই এখন মানবতার মূর্ত প্রতীক। তাবলীগ জামাতের দিল্লির নিজামউদ্দিন কান্ডে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল।ধর্ম নয় এখানে মানবতাই আগে। কে কোন ধর্মের বিভাজন নয়, মানবতা নিয়ে সেই তাবলীগ সদস্যরাই এখন অন্য করোনা রোগীদের সুস্থ করে তুলতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া তিন শতাধিক তাবলীগ সদস্য রক্তের প্লাজমা দান করেছেন। করোনা আক্রান্তদের সুস্থ করতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল অনুরোধ করেছিলেন, যারা সুস্থ হয়েছেন করোনাভাইরাসকে হারিয়ে, তারা যাতে নিজেদের রক্তের প্লাজমা দান করেন। এরপরই দিল্লির সুলতানপুরি সেন্টারে করোনামুক্ত হওয়া চার তাবলীগ সদস্য রক্তের প্লাজমা দান করেন। তাবলীগ প্রধান (একাংশ) মাওলানা মুহাম্মদ সাদও সদস্যদের প্লাজমা দান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
করোনাকে হারিয়ে সেরে ওঠা তিন শতাধিক তাবলীগ সদস্য দিল্লি সরকারের কনসেন্ট সেন্টারে নিজেদের প্লাজমা দান করার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, নরেলা সেন্টারের ১৯০ জন, সুলতানপুরি সেন্টারের ৫১ জন, মঙ্গলপুরি সেন্টারের ৪২ জন। দিল্লি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় আশার আলো দেখছেন।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্সেও প্লাজমা থেরাপির পথে হাঁটতে চলেছে । ২৭ তারিখ সোমবার শুরু হয়ে দিয়েছে তাবলীগ জামাতের ২০০ জন সদস্যের প্লাজমা সংগ্রহের কাজ। সুলতানপুরী এবং নারেলার দুটি কোভিড কেয়ার সেন্টারে শুরু হয়েছে এই কাজ। ঐদিনেই ২৫ জনের প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়ে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপিতে রক্তের প্লাজমা ব্যবহার করা হয় যাতে ভাইরাস ফাইটিং অ্যান্টিবডি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের শরীর থেকেই প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়। ঐ প্লাজমা দিয়েই চিকিৎসা করা হয় কভিড-১৯ তথা করোনা আক্রান্তদের।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্স-এর মেডিকাল সুপার ডা ডি কে শর্মা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকজন দাতার থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করেছি। এবার আমরা উপযুক্ত গ্রহিতার খোঁজে রয়েছি। এমন এক রোগীর প্রয়োজন যিনি ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রয়েছেন, অথচ প্লাজমা থেরাপি সহ্য করতে পারবেন।’ যাঁদের রেসপিরেটরি রেট ৩০-এর বেশি (২০ স্বাভাবিক) এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০ শতাংশের কম (৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ)স্বাভাবিক অথবা ফুসফুসে পাস জমেছে তাঁদেরই প্লাজমা থেরাপি করা হয়। যে সব রোগীর অবস্থা খুবই গুরুতর তাঁদের রাখা হয়েছে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্স-এর ট্রমা সেন্টারে। ভ্যাকসিন এবং ওষুধের অভাবে প্লাজমা থেরাপি দিয়েই চিকিত্সা চালানোর পথে এগিয়েছেন এদেশের ডাক্তাররা। এখনও পর্যন্ত, লোক নায়ক হাসপাতালে ৬ জন রোগীর প্লাজমা থেরাপি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য করোনার ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির আশংকায় ভারতজুড়ে চলছে লকডাউন চলাকালীন দেশটির রাজধানী দিল্লির নিযামুদ্দিনে তাবলিগ জামাতের একটি বৃহৎ জনাসমাগ/জোড় হয়েছিল । ঐ জোড়ে অংশগ্রহণ করতে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার তাবলীগ সাথিরা সমবেত হয়েছিলেন নিযামুদ্দিনে। এই বিশাল জনসমাবেশ থেকে অসংখ্য মানুষের ভেতর করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেওয়ার পর গোটা বিষয়টি নিয়ে তীব্র সাম্প্রদায়িক বিতর্ক শুরু হয়েছিল। বিতর্ক তুঙ্গে উঠে যখন ওই সমাবেশে যোগ দেওয়া প্রায় শদেড়েক ব্যক্তি করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়।
ভারতের বিশাল একটি অংশ তাবলীগ জামাতকে দায়ী করে বলেন, দেশে মহামারি আইন চালু থাকাকালীন এক জায়গায় হাজার হাজার লোকের সমাগম করে তাবলীগ ক্ষমাহীন অপরাধ করেছেন।এনিয়ে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদীর ক্যাবিনেটের একমাত্র মুসলিম সদস্য ও বিজেপি নেতা মুখতার আব্বাস নাকভিও মন্তব্য করেছিলেন, এই ধরনের সমাবেশ আযোজন করে তাবলীগ জামাত একটি ‘তালেবানি মাপের অপরাধ’ করেছে। এটাকে একটা ‘ক্ষমার অযোগ্য পাপ’ বলে বর্ণনা করতেও তিনি দ্বিধা করেননি।
ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও তাবলীগ তথা মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করে একের পর এক অনুষ্ঠান প্রচারিত করছিল। তার কোনওটির নাম, “ধর্মের নামে এ কোন প্রাণঘাতী অধর্ম?”। কোনও টিভি অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে, “করোনা-জিহাদ থেকে দেশকে বাঁচাও!”- ইত্যাদি। সেখানে ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, যে ইসলামী জিহাদের নামে একটা শ্রেণী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে ভারতকে বিপদে ফেলতে চাইছে।
মিডিয়াতে মুসলিম-বিরোধী প্রচারণার রেশ ধরে একজন আইনজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট প্রশান্ত ভূষণও আক্ষেপ করে বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত এই ভাইরাসের কোনও চিকিৎসাও নেই, কোনও টিকাও নেই!”
এই ঘটনায় তাবলীগের দায় যতটা, দিল্লি পুলিশ বা প্রশাসনের ব্যর্থতাও যে ততটাই – সেটাও আবার অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।“রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এবং দিল্লি পুলিশের নাকের ডগায় সব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাবলীগ এত দিন ধরে এত বড় জমায়েত করল, আর প্রশাসন কিছু জানতেই পারল না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?”, ফেসবুকে লিখেছেন অ্যাক্টিভিস্ট রজত ট্যান্ডন। দিল্লি পুলিশের নিজামুদ্দিন থানা যে তাবলীগের ওই মসজিদের একেবারে গা ঘেঁষে, সেটাও তিনি মনে করিয়ে দিযেছেন।
আনেকেই আবার তাবলীগকে সাপোর্ট দিয়ে জনসমাবেশ ইচ্চাকৃত নয় বলেন,
ঠিক এই ‘ট্রোল’দের প্রতি ইঙ্গিত করেই জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সদ্য বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ওমর আবদুল্লা টুইট করেছিলেন, “তাবলীগের এই ঘটনায় একদল লোক মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবেন।” #তাবলীগী ভাইরাস হ্যাশট্যাগ দিযে যারা টুইট করছেন, তারা আসলে প্রকৃতির সৃষ্টি করা যে কোনও ভাইরাসের চেয়েও বেশি ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন”, আরও লিখেছেন ওমর আবদুল্লা।
আরো পড়ুন : ইদের আগেই করোনা-মুক্ত হতে রমজানে বেশি করে ‘ইবাদত’-এর আহবান নরেন্দ্র মোদির
সাংবাদিক রানা আইয়ুব নামের একজন টুইট করেছেন, “যখন ভাবা হচ্ছিল লকডাউন এই দেশটাকে আরও বেশি দয়ালু আর সহানুভূতিশীল করে তুলবে, তখনই দেখা যাচ্ছে মানুষের সাম্প্রদায়িক চেহারা আরও বেশি করে ফুটে বেরোচ্ছে! মহামারি গুলি মারো, তার আগে মুসলিমদের তো ভিলেন বানানো যাক”, তাবলীগ আত্মপক্ষ সমর্থনে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটির সূত্র ধরে রানা আইয়ুব আরোও লিখেন “সরকার আচমকা লকডাউন ঘোষণা করায় ট্রেন-বাস-প্লেন সব বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই জমায়েতে আসা দেশি-বিদেশি লোকজন আটকা পড়ে গিয়েছিলেন।ফলে এখানে তাবলীগকে শুধু একতরফা দোষ দিলেই চলবে না”
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সাকেত গোখলে নামের একজন টুইট করেছেন গত ১৬ মার্চ দিল্লির কালকাজি মন্দির থেকে রিপোর্ট করা একটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজ – যেখানে দেখা যাচ্ছে শত শত মানুষ মন্দিরে ভিড় করে পুজো দিতে এসেছেন। অথচ এর চার দিন আগেই দিল্লি সরকার শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। তাবলীগ জামাতের মূল সমাবেশটিও হয়ে গিয়েছিল তার একদিন আগেই। ওই ভিডিও টুইট করে সাকেত গোখলে এটাই বলতে চেয়েছেন, সামাজিক দূরত্ব মানার শর্ত ভেঙে ধর্মীয় উপাসনালয়ে সমবেত হওয়ার জন্য একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে দায়ী করা ঠিক হবে না – এই ‘অপরাধে’ হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই অপরাধী।
আরো পড়ুন :গণজমায়েত বন্ধ করা না হলে গণলাশের মিছিল রোধ করা কী আদৌ সম্ভব?
তবে তাবলীগের ওই সভা নিয়ে মিডিয়া চ্যানেলগুলো কিংবা কোনও কোনও রাজনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্ট সাম্প্রদায়িক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেও দিল্লির পুলিশ ও প্রশাসন দাবি করছে, তারা বিষয়টিকে একেবারেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না। দিল্লির নিজামুদ্দিন থানায় অফিসার-ই-চার্জের সঙ্গে তাবলীগ জামাত কর্তৃপক্ষের সাত-আটজন সিনিয়র সদস্যের একটি বৈঠকের ভিডিও রেকর্ডিং সোষ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে অনেকেই বলছেন, পুলিশ অন্তত বিষয়টিকে ধর্ম দিয়ে বিচার করছে না। বিজেপি-পন্থী বলে পরিচিত বলিউড পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীও ওই ভিডিও পোস্ট করে টুইট করেছেন, “আমাদের পুলিশ যে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, এটা দেখে আমি গর্বিত।