এইচ এম মহিউদ্দীন চৌধুরী
ঊনিশত একাত্তরে ভেদাভেদ ভুলে আপামর বাঙালি জনতা অস্ত্র ধারণ করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায়-অগণতান্ত্রিকতা আর দু:শাসনের বিরুদ্ধে। যাবতীয় অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায়, অগণতান্ত্রিকতার বিপরীতে গণতন্ত্র, অসমতার বিপরীতে সমতা, অমানবিকতার বিপরীতে মানবিকতা, অধিকার হরণের বিপরীতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা-ই ছিল ঐতিহাসিক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।
লক্ষ লক্ষ বাঙালি নর-নারীর রক্ত-প্রাণের বিনিময়ে সবুজ দিগন্তে ভরা রক্তিম বৃত্তে আঁকা স্বাধীন পতাকা নিয়ে
আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম। যে স্বাধীনতার কথা স্মরণ করে আমরা বিশ্ববক্ষে গর্ববোধ করি। আমরা কি আমাদের জীবনের কঠিন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতার চেতনা লালন করি?
প্রশ্নটা এজন্য করলাম যে, চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি দিনটি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের ৩০ দিন বেতনের সমপরিমাণ ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের দিন। সোনালী ব্যাংক, বন্দর শাখার মাধ্যমে এ বোনাস প্রদান করা হয়। সেদিন ব্যাংক থেকে বোনাস তোলার জন্য সবার মতো আমিও ক্যাশিয়ারের সামনে চেক নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লাইনে আমার সামনে ছিল ২০ জন আর পেছনে ছিল প্রায় ৩০ জনের মতো লোক। দাঁড়াতে দাঁড়াতে শীতের দিনে রীতিমত আমার শরীর থেকে ঘাম বেরোচ্ছিল। এসময় হঠাৎ শুনতে পেলাম আমাদের লাইনের সামনে দিকে কিছুলোক ঁেচচামেচি করছে। প্রকৃত ব্যাপারটা জানার চেষ্টা করলাম। একলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই, কি হয়েছে? সামনে এতো শোরগোল কেন? লোকটি বলল, পেছন থেকে একলোক এসে লাইনের পরিবর্তে সরাসরি ক্যাশিয়ারের নিকট চেক জমা দিয়ে টাকা তোলার চেষ্টা করছে। তাই লাইনের দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ব্যাপারটি দেখতে পেয়ে প্রতিবাদ করছে। ঠিক এসময় যে লোকটি লাইনের বিপরীতে টাকা তোলার চেষ্টা করছে সে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার লাইনের দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি বলে আপনারা এ দেশে চাকরি পেয়েছেন। অন্যথা…। লোকটি তার কথা শেষ করতে পারল না। এসময় লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক লোক বলে উঠলো, আপনি হয়ত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা। তা না হলে নিয়ম ভঙ্গ করলেন কেন? এসময় লাইনের আরেক লোক বলতে লাগল, লোকটি যদি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা হতেন তাহলে লাইনে দাঁড়ানোই তার কাম্য ছিল। যা হোক- তারপর কী হলো আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না।
আমরা যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের দাবিদার। আমাদের কোনো আচরণ যেন এমন না হয় যা স্বাধীন বাংলার রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত প্রতীয়মান হয়। কেননা একাত্তরের স্বাধীনতার চেতনা-ই ছিল মানুষের পরস্পর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন দেশে ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকার সমানে সমান। এই অধিকার পাওয়ার জন্য মানুষ দেশ স্বাধীন করেছিল।
আসুন আমরা আমাদের বিবেকবোধ জাগ্রত করি। জীবন থেকে জীবনের অন্তে সকল দিগন্তে স্বাধীনতার মূল চেতনা লালন করি। ভেদাভেদ মূক্ত সুশীল সমাজ আর সাম্য-গণতন্ত্র রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেদের পেশ করি। তবেই তো চেতনা রক্ষা হবে। একথা অনস্বীকার্য যে- সকল সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নিকট সম্মানের পাত্র। কেউ কিন্তু আইনের উর্দ্ধে নন।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক