গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পটুয়াখালী ছিল অন্যতম হটস্পট। সেই সময় জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ২৫ জন আন্দোলনকারী, যাঁদের পরবর্তীতে শহীদ ঘোষণা করা হয়। আহত হন আরও ১৮৫ জন, যাঁরা পরিচিত ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে।
এক বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবারগুলোর জীবন থমকে আছে একই জায়গায়—স্বজন হারানোর শোক, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার কাঁধে চাপা পড়ে গেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আশার আলো এখন যেন আরও দূরে সরে যাচ্ছে।
এই পরিবারগুলোর অধিকাংশই দিনমজুর, রিকশাচালক বা হকার—প্রতিদিনের আয়ে যাদের সংসার চলে। অনেক শহীদ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের মৃত্যু যেন শুধু একজন মানুষকে নয়, পুরো পরিবারকেই ভেঙে দিয়েছে।
জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া এসব পরিবারের কেউ আজ ঘরহারা, কেউ ঋণের বোঝায় জর্জরিত, কেউ আবার অসুস্থ স্বজনকে নিয়ে বিপাকে। ওষুধ কেনা তো দূরের কথা, অনেকে নিজের খাবারের ব্যবস্থাই করতে পারছেন না। অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা স্কুল ছেড়ে কাজের খোঁজে ঢুকেছে শ্রমবাজারে—গার্মেন্টস, চায়ের দোকান, ইটভাটা বা নির্মাণসাইটে। শিক্ষার আলো থেকে অনেকেই এখন বঞ্চিত।
এই চাপ শুধু আর্থিক নয়, শারীরিক ও মানসিকও। শহীদ পরিবারের সদস্যদের অনেকে আজ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা বিষণ্নতায় আক্রান্ত। একদিকে অভাব, অন্যদিকে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকায় রোগগুলো দিন দিন জটিল আকার নিচ্ছে।
যেখানে আহত ‘জুলাই যোদ্ধারা’ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য একটি স্বাস্থ্য কার্ড পাচ্ছেন, সেখানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। পরিবারগুলোর দাবি—তাদেরও অন্তত এই ‘জুলাই স্বাস্থ্য কার্ড’ প্রাপ্য হওয়া উচিত।
শহীদ বাচ্চু হাওলাদারের স্ত্রী লাইলী বেগম বলেন, “ছোট ছেলেটাকে স্কুলে রাখার কথা ছিল, কিন্তু সংসার চালানোর কেউ নেই। বাধ্য হয়ে ঢাকায় কাজে পাঠিয়েছি। নিজের ওষুধ কেনার টাকাও পাই না।”
শহীদ রায়হানের বাবা কামাল আকন বলেন, “আমার ছেলেটা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমি এখন রোগে ভুগে মরছি। আমার স্ত্রী-মেয়েরাও অসুস্থ। চিকিৎসা করাতে পারছি না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, “যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তারা এখন অবহেলার শিকার। সরকার যদি দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা, ঘর ও আর্থিক সহায়তার বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই পরিবারগুলো ভেঙে পড়বে।”
এদিকে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ খালেদুর রহমান মিয়া জানান, “আহতদের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু আছে এবং তারা সরকারি হাসপাতালে সেবা পাচ্ছেন। শহীদ পরিবারের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে।”
শহীদ পরিবারের মানুষগুলো আজও প্রশ্ন করছেন—দেশের জন্য জীবন দিলেও কি তাদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই?