ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে গত ১৪ মাসের যুদ্ধে হাজার হাজার যোদ্ধা হারিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সশস্ত্র ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। গোষ্ঠীটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, নিহত যোদ্ধা এবং বিভিন্ন স্তরের নেতা-কমান্ডারদের সংখ্যা ৪ হাজারেরও বেশি।
এবং এদের অধিকাংশই নিহত হয়েছেন গত ২০ সেপ্টেম্বর লেবাননে আইডিএফের অভিযান শুরুর পর থেকে। টানা প্রায় ৭০ দিন ধরে অভিযান চালানোর পর গত পরশুদিন ২৬ অক্টোবর সেখানে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ইসরায়েল।
লেবাননের সরকারি পরিসংখ্যানও হিজবুল্লাহর হিসেবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দেশটির সরকারি তথ্য বলছে, আইডিএফের সাম্প্রতিক অভিযানে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে তাদের মধ্যে কতজন হিজবুল্লাহ কিংবা লেবাননের সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বেসামরিক কতজন — তা উল্লেখ করা হয়নি।
২০০৬ সালে একবার আইডিএফের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল হিজবুল্লাহর। সেই যুদ্ধে যত সংখ্যক গোষ্ঠীটির যোদ্ধা-কমান্ডার নিহত হয়েছিলেন, তার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি যোদ্ধা গত ১৪ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে গোষ্ঠীটির কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র।
প্রসঙ্গত, ইরানের সমর্থন ও মদতপুষ্ট হিজবুল্লাহ বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী। লেবাননভিত্তিক এই গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই গোষ্ঠীটি ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের অপর পাশেই লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল। এ অঞ্চলটি হিজবুল্লাহর প্রধান ঘাঁটি এবং গোষ্ঠীটির অধিকাংশ সামরিক স্থাপনার অবস্থান সেখানে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাস অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা এবং ২৪২ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে আনার পর গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ।
এদিকে গাজায় আইডিএফের অভিযান শুরুর পর থেকে হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া শুরু করে হিজবুল্লাহ। পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে ইসরায়েলও। গত ২০ সেপ্টেম্বর লেবাননে আইডিএফের অভিযান শুরুর আগে এক বছরে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে লেবাননে প্রাণ হারান ২ হাজারেরও বেশি মানুষ।
তবে লেবাননে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গত প্রায় ৭০ দিনের অভিযানে হিজবুল্লাহর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা রীতিমতো অভূতপূর্ব। হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা ও সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহসহ গোষ্ঠীটির প্রায় সব শীর্ষ কমান্ডার এ অভিযানে নিহত হয়েছেন। ফলে গোষ্ঠীটির চেইন অব কমান্ডের সর্বোচ্চ স্তর তছনছ হয়ে গেছে। গোষ্ঠীটির বর্তমান জ্যেষ্ঠ নেতারাও স্বীকার করেছেন যে ইসরায়েলের অভিযানের ধাক্কায় গোষ্ঠীটি ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে।
দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দা হাওরা নামের এক নারী জানিয়েছেন, তার নিজের পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অনেকেই হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুক্ত। রয়টার্সকে হাওরা বলেন, “আমার এক ভাই শহীদ হয়েছে, একজন দেবর গুরুতর আহত এবং আমার প্রতিবেশী ও আত্মীদের প্রায় সবাই হয় শহীদ, নয়তো আহত বা নিখোঁজ।”
“আমরা তাদের কবরস্থ করার জন্য দেহাবশেষ সংগ্রহ করতে চাই। আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘর ফের মেরামত করতে চাই।”
ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে গত ১৪ মাসে লেবাননে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। যেসব এলাকায় হিজবুল্লাহর প্রভাব বেশি, বাস্তুচ্যুতির হারও সেসব এলাকায় বেশি।
লেবাননের একজন সেনা কর্মকর্তা, হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যার ভালোভাবে পরিচয় আছে— রয়টার্সকে বলেন, ‘হিজবুল্লাহর অবস্থা বর্তমানে আহত মানুষের মতো। একজন শয্যাশায়ী আহত মানুষ কি উঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে পারে? তার সেই শারীরিক ক্ষমতা থাকে?- থাকে না; বরং সে নিজেকে সুস্থ করে তুলতেই বেশি মনোযোগ দেয়।’
হিজবুল্লাহও জানিয়েছে যে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর এখন আপাতত নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করা, ধ্বংসপ্রাপ্ত সামরিক স্থাপনাগুলোকে পুনঃনির্মাণ করা এবং গত ১৪ মাসে যেসব ভুলের কারণে আজ হিজবুল্লাহর এই অবস্থা— সেসব পর্যালোচনা করাকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে।
গোষ্ঠীটির জ্যেষ্ঠ নেতা ও রাজনীতিবিদ হাসান ফাদাল্লাহ রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে লেবানন জনগণ— তাদের আশ্রয় দেওয়া, ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা এবং যারা শহীদ হয়েছেন— তাদের তালিকা চূড়ান্ত করা এবং যথাযথ মরণোত্তর সম্মান প্রদান করা। এসব কাজের পর আমরা নিজেদের পুনর্গঠনে মনযোগ দেবো।” সূত্র : রয়টার্স