কবিতাগ্রন্থঃ বাঞ্ছাকল্পতরু
প্রচ্ছদঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশকঃ শাঁখ
ব্যক্তিগত পুকুর অথবা পাখির কথা
চড়ুইভাতি পুকুরে ভাসে পদ্মের দল। পুকুরে বাড়ন্ত মীনের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমাদের অপার আমোদ। কী সুন্দর দুলেছে পৃথিবী। চারপাশে শৈশবের বন্ধুরা যে যার মতো গড়েছে সংসার। অথচ আমার কোন ব্যক্তিগত পুকুর ছিল না। সেই থেকে চড়ুইভাতির দিন এলে পুকুর পাড়ে মালিকানার আশায় কেটেছে সময়। পাশে ঘনকালো ছায়ারা খেলেছে বাহারি মুগ্ধতায়।
মনে হলো কী হবে পুকুর দিয়ে বরং ব্যক্তিগত কোন পাখি দরকার। যার ডানায় বাতাসের সুগন্ধ আর ঠোঁটে বিবিধ ফলের সুবাস। একদিন পাখির আধখাওয়া ফলে কামড় দিয়ে জেনেছি- পাখিদের কোন মালিকানা হয় না। এসব ইচ্ছের মাঝে একদিন সংসারে হানা দিল জন্মগোত্রহীন সারমেয় দল। পুকুরের মাছ আর আকাশের পাখির কথা ভুলে সারারাত ঘুরেছি বনে বাদাড়ে। জঠরের অন্ধকার ভেদ করে যেদিন আলোর মুখ দেখলাম ততোদিনে কেটেছে বীভৎস নয় মাস।
উদ্বাস্তু রোদ
যতোই দূরে যাই- পড়ে থাকি জানালার পাশে। এখানে অন্ধকার ঘিরে আলো রেখা খেলে যায় নিবিড় আমোদে। কলাপাতা, মেহগনি আরো কতো বৃক্ষের কাছে রেখে আসি অবাক শৈশব। উঠোনে আলো ঝলকায় প্রজাপতি ফুলে। গন্ধরাজ ওগো বিভোর সুরভি- কোথায় হারালে বলো কোন অজানায়। গোলাঘরে ঢুকে না আলো- যমের আঁধার। জমিজমা নেই কিছু- চারিদিকে মুখের বাহার! গেরস্থ গিয়েছে হেঁটে- উদ্বাস্তু রোদ মেখে শহরের দিকে।
যেখানেই যাই নাকো- পিছু হাঁটে জানালার আলো। এক হাতে আলো আর অন্য হাতে কালো। এখানে খেলেছি বসে নিয়মের সুরা নিয়ে মদির আরাম। কখনো পারিনি যেতে এসবের সুর হতে দূরের বাগানে। নিজেকে জ্বালিয়ে যাই- নিবিড় প্রেমের কাছে রেখে আসি আহত বেদনা। সব স্মৃতি সুনিপুণ আলো ফেলে- মেঘেদের তুলো রঙ উড়ে যায় বিষুব বাতাসে। এখানে জানালা নেই- কাচঘেরা রঙ আছে পুঁজিপতি অন্ধদের ভিড়ে। তবুও হারিয়ে যাই- মাঝে মাঝে উদাস পুরীর দিকে। এ বুঝি সেই পথ- যেখানে ছিলাম শুধু বাহারি দৃশ্যের ভেতর।
চকবাজার মোড়ে নাগরিক আঁধার
আপাত শূন্যতার ভেতর জ্বলে পরিচিত আলো। পথের পুলক ছেড়ে দূরে যেতে পারা ভালো। চিহ্নের মায়া নিয়ে অনাড়ম্বর হাঁটি পথে। পদচিহ্নের খোঁজে চকবাজারের চৌরাস্তায় গিয়ে দেখি- চারদিকে নেমেছে রমণীয় সন্ধ্যা। পথের উচ্চতা বেড়ে সভ্যতা গিয়েছে ঢেকে পলিমার পিচে। মানুষের অন্ধকার নেমেছে নর্দমার ভেতর কর্ণফুলীর জলে। অনিন্দ্য প্রাচীন ফুল ভেসে গেছে ধুনির পুলের নিচে। কর্ণফুলী এসবের কিছুই জানে না। অথচ তার বুকে ফুলগুলো পরিযায়ী জাহাজ হয়ে ঘুরে। কাঁচাবাজারের ভিড়ে অপ্রাপ্ত চুমুগুলো কবুতর হয়ে উড়ে গেছে দখিনের দিকে। দখিনে আমার কোন ঘর নেই। কোন নোনা সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের জলে। জল বুঝেনি জাহাজের সভ্যতা। আমার সভ্যতা জানে না অস্বীকারের রঙ। তাই রঙের বাতি হাতে অপূর্ব আরতি আজ পাললিক পথে। আমি পথ-ফুল-জল নিয়ে মাপি নাগরিক আঁধার।
পুকুর ঘাটের কথা
সময়ের হাতে হাতে বেড়ে ওঠে নতুন নিয়তি
নিদাগ মননে লাগে কতো বিনোদন- নিশিদিন
গাঁয়ে ফিরি মেঠোপথে স্বপ্নবাজ- উদোম বালক
যেখানে পুকুর আর মাছ ধরা জাল- মাছরাঙা।
নিখুঁত নিয়ম মেনে উড়ে যায় বিলের বলাকা
উঠোনে বিকেল নামে লালরাঙা- কবুতর ডানা
জানালার পাশে বসে পরিচিত আলো ঝলমল
মেহগনি গাছে জ্বলে গেছে ভোর- অন্তিম আগুন
দিদির দলিত মন নিভে যায় চোখের আলোয়।
পুকুর ঘাটের কথা বলব কী! চিনেনি আমায়
কামরাঙা গাছ শুধু হেসে হেসে তির্যক দুলেছে
ওপাড়ার সনাতন সুধীজন হেঁটে গেছে পাশে।
বেড়েছি দারুণ স্রোতে সময়ের তাত- ভদ্রলোক
শিমুল তমাল আমি উঠেছি উঁচুতে ভাসমান
হয়ে গেছে ছোট সব পুকুর গুদাম গোলাঘর
চেনা পথ সুর তোলে অচেনারে ডাকে অনায়াসে
কান্নার কেমন স্বর চুপচাপ রাতুল বেদনা।
তমিস্র স্বর্গ
সূর্যাস্তের আগে আঁধার জমে চারপাশ। ভাবি- চোখে নেমে এলো এ কোন কর্পোরেট ছানি? হাতে চোখ ঘষে দেখি বগলে সূর্য নিয়ে ঢুকেছি আদিম গুহায়। গুহার ভেতর জ্বলে সোমত্ত চাঁদ আর হিলিয়াম তারা। অদ্ভুত শিল্পের ভেতর ধরা দিল বিনয় ঈশ্বরী। তমিস্র মায়ার ভেতর তিলোত্তমা খুলে দিল বর্ণিল সম্ভার। আঙুরের রসে মাতাল তিলোত্তলা বলে- ছুঁলেই কেন অঙ্গ খসে যায়! আমাকে ছুঁয়ো না পান করো হে নিমগ্ন মানুষ।
শীতের সুবাস
শীতেরও সুবাস আছে
ঝিমলাগা পাখিসব জাগে
ভেজা পাতাদের ভিড়ে
রোদের নরোম ছোঁয়ায় কাঁপে সৌম্য সকাল।
তোমার বুকে ঘুরে শীতগন্ধী উষ্ণতা
নিবিড় আলিঙ্গন হতে চোখ মেলে দেখি
আনত রোদের শরীর
কিছুটা তুলো তুলো ছোঁয়ায় জাগে নিয়মের দেহ
এ কোন হরণ বলো- নিটোল সৌরভ!
দূরে দূরে যাও যদি ঘাসের শিশিরে
পাতার ফাঁকে জাগে নমিত নতুন
এখানে আছি আমি নিমগ্ন পুরুষ
ওপারে মেলে আছো সুঠাম শরীর।
যে পাখি উড়ে গেছে অন্যবাগানে
ওখানে কি আছে ভোর এমন তুমুল
এখানে চারপাশে সুবাসের সুর নাচে
শীতের শীৎকারে ঘুম ভাঙে পাখিদের দেহে।
পারিজাতের মুগ্ধতা
হৃদয়ের কোন রঙ নেই
তবুও হাজারো রঙে হয়েছি মরমি
তোমার মুগ্ধ মুদ্রার ভেতর ডুবে দেখেছি
এ বড়ো অদ্ভুত রঙ- আসমানি!
নির্মোহ মেঘ ভেসে গেছি দিগন্ত রেখায়।
হৃদয়ের আছে পারিজাতের মুগ্ধতা
চারদিকে মাটির কাঠামো
ওগো- ছুঁয়ো না মাটি!
যেদিন সব রঙ মিলে হবে সূর্যের শাদা
তুমি হয়ে ওঠো নমিত কৃষক
ফসলের ঘ্রাণে ঋতুবতী হবে মাঠ।
এভাবে পৃথিবীর পাহাড়গুলো হলো বয়সী
নদীরা সমুদ্রের কাছে যাবে বলে
ঢুকে পড়লো জনপদে আর ফুলগুলো
ভুলে গেলো ঋতুর মমতা।
অবশেষে সব রঙ চুষে হয়েছি দারুণ কৃষ্ণ
রাধা শুধু পথ ভুলে মিশে গেছে আঁধারে।
স্মৃর্র্তির কারুকাজ
ফিরে আসে নিবিষ্ট সুরের আলপনা
এঁকে দেয় পুরনো দৃশ্যের রেখাচিত্র
বিমূর্ত ঘোরের মাঝে ফোটে শপথের অভিজ্ঞান
অবহেলার মূর্তি হয়ে হাসে- বাজে নিঠুর বাঁশি।
এই গ্রহ ছেড়ে যেখানে গিয়েছ তুমি
সেখানে বাজে না কোন বিমূর্ত সংকেত!
বড়ো বেশি ধ্যানে- পার্বতী নর্তকী হয়ে
নেচে যায় দিশেহারা শিবের সমুখে।
এখানে অষ্টপ্রহর করেছিলে নিবিড় কীর্তন
সুরের মুগ্ধতায় ভেসেছে চারপাশ
নারীরা দিতে পারে বেশ- মেঘ-বৃষ্টি-বায়ুর রেশ!
জানি তুমি আসবে না কাছে
দিবে নাতো নতুন আমোদ
তবুও কেন যে মনে ভাসো- কাছে আসো
দিয়ে যাও পুরনো স্মৃর্র্তির সাথে মুগ্ধ কারুকাজ!
বোশেখের শোকগাথা
উৎসবের মেঘ-রাঙা দিনগুলো ফিরে আসে নিবিড় চেতনায়। রঙিন ঠোঁটের রঙে ঝিলমিল চারিধারে বাজে বাহারি সুর আর প্রেমময় হাওয়া। উত্তাপের বোশেখি মমতা জড়িয়ে মধুর চিত্ত সুধা ঢালে বটের ছায়ায়। ভোরে সূর্যের সমুখে দাঁড়ানো আমার পা ছুঁয়ে চেয়ে নাও আগামীর অজানা সময়। দুহাতে তোমাকে তুলে কপালে চুমু চিহ্ন এঁকে দিয়েছি বুকের অনন্ত অনুরাগ।
আট বছর কেটে গেছে বাহারি বন্ধুর পথ…
রঙিন পাঞ্জাবি পাশে লাল পেড়ে শাড়ি নেই। আরো দূরে ঘোরে মাঠের মেলায় নিমগ্ন মানুষ। নাগরদোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে মাতাল কিশোরী ঠিক খুঁজে পায় বেভুল মুগ্ধতা আর বিদগ্ধ বেলা। তুমি শুধু উড়ে গেছো রঙিন বায়ুর বেলুন।
বোশেখের বিনম্র বেদনা ছেড়ে যাবো কতদূর? কোথায় পাবো সেই নগ্ন অনামিকা আর স্নিগ্ধ ললাট। রেখেছি যতনে যারে নির্ভার মন সঁপে সে যদি জানে না বুঝে না বলে চলে যায় দূরে। বিদগ্ধ বুকে প্রশান্তি হারায়ে বোশেখের রৌদ্র প্রতাপে হায় হায় করে বয়সী বাতাস। কোনদিন আমলে আসেনি অনামিকা স্বর্ণশোভা। জানিনি গোপন ব্যথা জড়িয়ে রয়েছে হাত। বুঝিনি কতো ব্যথা দিতে পারে বোশেখের রাত। আংটি যে গড়ে দিল এতো কিছু অদল বদল।
বাঞ্ছাকল্পতরু
১.
তোমাদের নিঝুম প্রেম থেকে দূরে
যেখানে নিবিড় আরাম ডাকে প্রাণের মায়ায়
ক্ষণকাল আকাল পেরিয়ে গড়েছি নিয়মের সংসার
তরুণ তীর্থের পথে ধ্যানের সুরভি মেখে হাঁটি
খুঁজি পঞ্চবটির বিস্তৃত শাখা প্রশাখা- বিবেকানন্দ প্রেম।
আমি ব্রহ্মচারী নই- শুধু বিবিধ বেদনায় হয়েছি আকুল নরোম
আশ্রমের প্রতিটি দেয়ালে লিখে যাই জীবনের নিবিষ্ট সূত্রমালা
জপমালায় ভরসা নেই- শুধু বিধানের নিয়ম ভেঙে গড়ি বিপুল পৃথিবী।
মানসিক সূত্রের বিন্যাসে লাগে অসীমের ঢেউ
দুলে ওঠে পাল হয়ে বেসামাল নমিত নৌকায় লাগে দোলা
মানে-অপমানে, শত্রু-মিত্রে, শোকে আর সুখের ব্যবধান যায় গুছে।
২.
পাহাড়ের আনত বাধা পেরিয়ে মেঘের কাছাকাছি
ওখানে কোন যোগী নেই- মানুষ বড়ো বেশি গৃহস্থ মায়ায়
লুকিয়ে রেখেছে সমূহ সন্ন্যাস আর নিয়মের উপাচার
দেখা হলো এক জোড়া কাঠবিড়ালির সাথে
যারা গত জন্মে সাধুর ভান ধরে নিয়েছিল গৃহস্থ কামনা
এখানে মেঘের ভাসমান জল ছাড়া কিছু নেই
যারা এসেছে পৌরাণিক প্রতীকের কাছে চন্দ্রনাথ চূড়ায়
তারাও পুণ্যের জলে ডুবে যাবার আগে ভাবে
কোন রত্নাকরের দস্যুপনার কথিত গল্পের ছবি।
পাপ আর পুণ্য কোনটাই টানেনি তেমন
শুধু ডুবে গেছি বিবিধ বৃক্ষের ছোঁয়ায়
অবিন্যস্ত সিঁড়ি-পথের প্রতিটি পাথরের কাছে
রেখে আসি কিছু অব্যক্ত ঘাম আর সুতীব্র নিশ্বাস।
শিউলি বিছানো পথের মায়ায় পেয়েছি স্বর্গীয় আমেজ
এসবের মাঝে গড়েছি কামে প্রেমে বাঞ্ছাকল্পতরু।
৩.
মানুষ জানে ভালো
জীবনে কতোটা আলো ছড়াতে হয়
কথার মায়ায় বেঁধেছিল যে বোষ্টমী
তাকে আজ আর কোথাও দেখি না
পথিক শুধু পথের ইশারায় হেঁটেছে সুদূর।
৪.
হাতে বিষণ্ণ বিকেল তুলে দিয়ে কোথায় গেলে?
সব সুর মুছে নিয়ে এ কোন পথে ছুঁড়ে দিলে মোহের বেলুন
অথচ তোমার চোখের স্বপ্নে বানিয়েছি সুরম্য ভুবন।
শীতের রোদ বুকে মেখে তোমাকে করেছি নমিত রমণী
চঞ্চল পাখি ওড়ে
ঘুরে ঘুরে বাড়ে নতুন সকাল।
গন্ধরাজের মাতাল সাহসে বিভোর দিন দোলে নীরবে
ঝরা পাতার সাথে উড়ে গেছি দূরে
শুধু ভুল করে কী রেখে গেছি জানা নেই!
এখনো এক হাতে বিষণ্ণ বিকেল
অন্য হাতে অচেনা জীবন!
৫.
এসেছো আবার ফিরে
মানুুষের ভিড়ে!
সূর্যখোলার মেলায়
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হলে
বটের ছায়ায় এসো
দুমুঠো সুখ নিয়ে খেলি
বিষণ্ণ পাখিদের মাঝে!
৬.
শিরদাঁড়ায় খেলে যায় শীতল হাওয়া
একটি খবর উড়ে গেলো কানের পাশে
হয়তো তার কিছু দিয়েছিল দোলা মরমে।
শুনেছি খুব সহজে ধারণ করেছো সামাজিক বীর্য
অবলীলায় শরীরে উঁকি দিচ্ছে নতুন প্রভাত।
অথচ একদিন অবারিত আঁচলে মুছে নিয়েছো আদরের রেণু
পরাগের তাড়নায় দিয়েছিলাম প্রাণ
তুমি প্রাণের মর্ম না বুঝে নিমেষে হলে নতুন নর্তকী।
রমণী তুমি কবে নারী হয়ে গেলে বলো?
তোমার সমগ্রতাকে ছুঁয়ে দেখেছি
তুমি বড় বেশি রমণী রয়ে গেছো
যেখানেই যাও- মেলে ধরো অবারিত সম্ভার!
কাছে এসো না তুমি
আমি অনন্তের পথিক হবো!
৭.
সুরের অসংগতে
নিদ্রামগ্ন শ্রমণ বুঝনি সংযত রিপুর তাড়না!
সংযমের বেদনায়
নির্বাণের আঁধারে জ্বলে নতুন বোধি।
জলের মন্থনে
গড়েছি বোধীর চেয়ে কিছু বেশি
এসবের সংগতে
ডুবি আর ভাসি আমূল দিবানিশি।
Posted by earthnews24 on Sunday, January 24, 2016