ডা: এস কে দেব সজল
আজ ১০ এপ্রিল হোমিওপ্যাথি দিবস ও মহাত্মা হ্যানিম্যানের ২৬০ তম জন্মদিন। ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত জার্মানীর স্যাক্সানি নামক প্রদেশের মিশেন নামক ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেন। বালক হ্যানিম্যান স্বীয় অধ্যাসায় ও প্রতিভা বলে দারিদ্র্যের সাথে অবিরত লড়াই করে বিভিন্ন ভাষায় ও বিজ্ঞানে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। ১৭৭৫ সালে বিদ্যালয় হতে বিশেষ প্রশংসার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বিজ্ঞানী হ্যানিম্যান লিগজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। পরে তিনি এক বিখ্যাত চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ১৭৭৯ সালে পরীক্ষা দিয়ে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর হ্যানিম্যান জার্মানীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০ বৎসর যাবৎ চিকিৎসা সেবায় ব্যস্ত থেকে নিজ প্রতিভাবলে বেশ সুনাম ও খ্যাতি লাভ করেন। হ্যানিম্যান নিজ প্রতিভা বলে বেশ খ্যাতি অর্জন করলেও ক্রমশ তৎকালীন প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র পুস্তক অনুপাত করে কেমিষ্ট্রি বা রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে কয়েক বৎসর অতি কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেন। এই সময়ে তিনি কার্লেন্স মেটেরিয়া মেডিকা নামক একখানি বড় ভেষজ গ্রন্থের অনুবাদ করবার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। গ্রন্থখানিকে ভাষান্তর করবার সময় একদিন হঠাৎ একটি ব্যাখ্যা বা “প্যাসেজ” এর প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তাতে তিনি সর্বপ্রথম হোমিওপ্যাথিক মূলমন্ত্র: “সমঃ সমং শময়তি” “ঝরসরষরধ ঝরসরষরনঁং ঈঁৎধহঃঁৎ” সমন্ধে অনুপ্রাণিত হন। ঐ গ্রন্থের কোন জায়গায় এ রূপ লিখিত আছে যে, “কুইনানের উৎসস্বরূপ সিঙ্কোনা বা পেরুভিয়ান বার্ক এর যে জ্বরনাশক গুণ আছে তার কারণ কি? তার কারণ এই যে, এর সুস্থ শরীরে জ্বর সদৃশ অবস্থা উৎপাদন করবার শক্তি আছে। এই সত্যের আলোকশিখাটুকু অবলম্বন করে হ্যানিম্যান জ্বরের স্পেসিফিক “সিঙ্কোনা” বা “চায়না” সুস্থ শরীরে জ্বরবৎ অবস্থায় উৎপাদনক্ষম কিনা তা নিজ দেহে পরীক্ষা করে যাচাই করতে উদ্যত হন। পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানে তাদের দৃঢ় ধারণা হয় যে, সুস্থ শরীরে “সিঙ্কোনা” বা “চায়না” ম্যালেরিয়া জ্বর সদৃশ অবস্থা উৎপাদন করতে সক্ষম বলে তা ম্যালেরিয়া জ্বরের পালা নিবারণ করতে পারে। সদৃশভাবে তিনি আরো অনেক ঔষধাদির গুণ নিজ দেহে পরীক্ষা করে এক নতুন ধরনের মেটেরিয়া মেডিকা প্রস্তুত করতে থাকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে হোমিওপ্যাথির অভিনব “আময়িক বিধান” অনুসারে চিকিৎসা করতে অনুপ্রাণিত হন। এভাবে ১২ বৎসর সাধনা করবার পর এবং তৎসঙ্গে মেডিক্যাল জার্নাল প্রভৃতিতে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির দোষসমূহের তীব্র সমালোচনা ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির উৎকর্ষতা সম্বন্ধে চিকৎিসক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করে তিনি তৎকালীন চিকিৎসা জগতে এক ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত করেন। সংরক্ষণশীল চিকিৎসকবৃন্দ একযোগে তাঁর সারগর্ভ উপদেশের প্রতি কর্ণপাত না করে তাঁর উন্নতিতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাঁর অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতির বিরদ্ধে দন্ডায়মান হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। হ্যানিম্যান স্বহস্তে ঔষধ প্রস্তুতকরণের স্বপক্ষে এক প্রকার যুক্তি প্রদর্শন করতেন: হোমিওপ্যাথির শৈশবে পাছে পরের হাতে ঔষধ প্রস্তুতকরণের ভার দিলে ঔষধের আসল গুণ বা পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়, এই বিষয়ে তাঁর সর্বাপেক্ষা আশংকা হতো। কারণ, তখন দেশে তাঁর বিরোধী দল প্রবল ছিল, চক্রান্ত করে স্বল্প পয়সা উপার্জনকারী কম্পউন্ডারকে হাত করতে বেশি সময় লাগত না। কম্পাউন্ডার পাছে কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করে “অ্যাকোনাইটের” পরিবর্তে “বেলেডোনা” দিয়ে বসে এবং নবজাত শিশুর হোমিওপ্যাথির সর্বনাশ সাধন করে এই বিষয়ে তাঁর মনে খুবই ভয় ছিল। এ জন্য তিনি দুনিয়ার কারও হাতে এই দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার ন্যস্ত করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। ফলে তাকে বহু কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। তৎকালীন প্যারিসের কোন এক সন্ত্রান্ত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত পরিবারের কন্যা এক অতি কঠিন ও পুরাতন রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু বৎসর যাবৎ মৃতকল্পা হয়েছিলেন, হ্যানিম্যানের চিকিৎসারগুণে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে আশ্চর্যভাবে ও সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করায় তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ অবশিষ্ট জীবন তাঁকে সেবিকা হিসেবে আত্মদান করার প্রস্তাব করেন। এই সুন্দরী ও সন্ত্রান্ত কন্যার সাথে অতীব পরিণত বয়সে তিনি দ্বিতীয় বার পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ভদ্র মহিলা অনেক সম্পত্তির অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর অর্থে, আন্তরিক সেবায় ও যতেœ হ্যানিম্যানের শে জীবন বেশ শান্তিতে কেটেছিল। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। বিখ্যাত অঙ্কশাস্ত্রবিদ নিউটনের “আপেল ফল পড়ে কেন?” তত্ত্ব আস্কিার করতে গিয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব অনুভূতির ন্যায়, হ্যানিম্যানের “সিঙ্কোনা বল্কল্ হতে স্বল্প বিরাম জ্বরের সদৃশ অবস্থা উৎপন্ন হয় বলে উহা ম্যালিরিয়ার স্পেসিফিক” “সমঃ সমং শময়তি” এই তত্ত্বের আবিস্কার জগতের ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। প্রায় চার শতাব্দী পূর্বের প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রবর্তক ও জার্মান দেশীয় ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের মতন হ্যানিম্যানকে তৎকালীন গোঁড়া চিকিৎসকদিগের চিকিৎসা পদ্ধতির নানা প্রকার ভ্রম, কুসংস্কার ও মতবাদের বিরুদ্ধে একাকী দাণ্ডায়মান হতে হয়েছিল। এজন্য তাঁকে অনেক লাঞ্চনা, নিগ্রহ এবং দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল। তথাপি তিনি অটলভাবে উচ্চকণ্ঠে “সদৃশ বিধান মন্ত্রের জয়” ঘোষণা করে
গিয়েছেন।