জন্মক্ষুধা
সময়ের আগে আগে উড়ে যে পাখি, সে নতুন কথা বলে- ধ্যান শেষে পূর্ণিমার জোছনার মতো এই উপলব্ধি হয়েছিল রাতের। আমি অন্ধকারে পেঁচার মতো ছুটে চলা সেই পাখি। দুধরাজ সাপের কাছে শিখেছি, সৌন্দর্যের মতো ফণায় লিকলিকে জিহ্বার ছবি আঁকতে হয়। সে জিহ্বার লালায় মৃতদের স্মৃতির মতো রূপসীরা শীৎকার করে আর উল্কার মতো ছিটকে পড়ে একেকটি ছায়াপথ। যে পথে হেঁটে যায় মায়াদের মতো প্রাচীন বটেরা।
আমি বটেদের আশ্রমে দেখেছি, শিকড়ের মতো ঋতুবতী নারী; যার সৃজনবেদনার কুমারী ঘ্রাণ মানুষের চোখে জাগিয়েছে নেশা। আর সময়ের শরীরে দেখেছি, স্পর্শফলের মতো জন্মক্ষুধা। যে ফল থেকে জন্ম নিয়েছে কৌতূহলের মতো এক উঁইপোকা। আলোর ফাঁদে পড়ে সেই উঁইপোকা চিৎ হয়ে ঘোরে … ঘোরে … ঘোরে। মাংসাশী পিঁপড়ার দল তার মাথা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। মস্তকহীন সেই উঁইপোকার মতো আমি পা দিয়ে আঁচড় কাটি বাতাসে।
পেছন মুখ
তোমরা আমার যে মুখটা দেখ, সে তোমাদের পরিচিত। এর বাইরেও আমার একটা লুক আছে। আমার মাথার পেছন, ঘাড়, পিঠ- এ তো তোমাদের চেনা নয়। ও যদি কখনো তোমাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন কি চমকে উঠবে? বলবে, কে আপনি? আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে মোটেও সামনেকে হাজির করবো না। আমার পেছনটাও তো আমি। সে পড়ে আছে অবহেলায়। আমারি একপাশ আরেকপাশকে লুকিয়ে রাখে।
একবার পেছনটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি চমকে গিয়েছিলাম। এই আমি তো আমি না। এরপর থেকে আমার আমিকে আমি দু’ভাগ করে দিয়েছি। একভাগ সামনে, বাকিটা পেছনে।
মর্মর
মৃত্যুর কাছাকাছি যে নক্ষত্র সেই বেশি আলো দেয়- এ কথা বলে প্রাচীন কুয়া থেকে দীর্ঘ বাতাস উড়ে গেল। থোকা থোকা লাল বটফলের মতো করুণ ক্ষুধার লোভে আমি এই শহরে হাঁটি। শহরের আইল্যান্ডে পাতা ঝড়ার শব্দে নদির কান্না ভেসে আসে। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় জানালার কার্নিশে জোয়ার ভাটার শব্দে শহরের বয়স বাড়ে।
প্রতিটি ঘুম মৃত্যুর কাছাকাছি বলে অন্ধকারের মতো রাতকে ওরা নিয়ন আলোয় ছড়িয়ে দেয়। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার মতো প্রতিটি ভোর শুরু হয় হাতুড়ির শব্দে। রেল লাইনের ওপর খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকে যে নারী ট্রেনের হুইসেলের মতো সভ্যতা তাকে তাড়িয়ে দেয়। হৃদয়ের কালো কালো ক্ষত হেমন্তেবসন্তে শুভ্র হয়ে যায়। কালের হাসি কসাইয়ের দোকানে কলিজার মতো ঝুলে থাকে। অস্ত গেলে সূর্য মৃত্যুর মতো।
সিদ্ধেশ্বরী
সিদ্ধেশ্বরী, তুমি পাহাড়ে ফোটা অচেনা হলুদ-হরিণ ফুল
ফাল্গুনে যদি কোকিল না ডাকে, বসন্ত বৃথা
তস্কর নই আমি, পূজারী মাত্র;
চৌবাচ্চায় কুমির পুষে মাছ চাষ করো
ধুপছায়া রঙের ঘোড়ার মতো আমি, তীরবিদ্ধ
রীতি না জেনে যুদ্ধে আসা, অর্বাচীন;
পারণ যদি হয় একটা চুমু
পিপাসার্ত জীবন আমি উপবাসে কাটাতে পারি
আশ্রম কোলে দাও ঠাঁই, দেবি, নত হই;
একটা
একটা ঢোল বেজে চলে। একটা ঘুড়ি ছিঁড়ে যায়। একটা ফানুস উড়ে যায়। একটা বেলুন ফেটে যায়। একটা সময় হারিয়ে যায়।
একটা বিকেল সন্ধ্যা হয়। একটা স্টেশন থমকে থাকে। একটা মানুষ ট্রেন খোঁজে। একটা পাখি নীড়ে ফেরে। একটা দিন হারিয়ে যায়।
একটা বালক স্কুল পালায়। একটা মাঠে সর্ষে ফুল। একটা পথ কাদায় ভরা। একটা জীবন রোদ্দুর হয়। একটা আলো হারিয়ে যায়।
একটা কথা অনেক কথা। একটা ভাষা চুপ থাকা। একটা হাসি অনেক কিছু। একটা ভুল খুব ভারি। একটা স্বপ্ন হারিয়ে যায়।
একটা তারে সুর বাজে। একটা বাউল গান গায়। একটা বাতাস উজান বয়। একটা নদি ঢেউ তোলে। একটা নৌকা হারিয়ে যায়।