লিটন দাশ গুপ্ত
‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ -শিরোনামে লেখাটির শিরোনামই হচ্ছে একটি পাঠ্যবইয়ের নাম। যা স্নাতক পর্যায়ে ২০১৩–১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে, বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুরুতে এই পাঠ্যপুস্তক ১ম বর্ষ থেকে ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত, সকল ছাত্রছাত্রীর জন্যে আবশ্যকীয় করা হয়, যাতে ১ম বর্ষ শেষ করা শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষাক্রম থেকে বাদ না পড়ে। পূর্ণমান ১০০ নম্বর, ক্রেডিট-৪ এর, এই বইটি স্নাতক (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর সকল ধারার ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। অর্থাৎ বিএ, বিএসএস, বিএসসি, বিবিএস, বিবিএ ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থীকে এই বই অবশ্যই পড়তে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বাঙ্গালী জাতির জন্যে এক গৌরবময় ইতিহাস। যা এই দেশের মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙ্গালী জাতির জন্যে অর্জিত হয়েছে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের স্বাধীন ভুখন্ড ও লাল সবুজের পতাকা।
সময়ের পরিক্রমার সাথে সাথে দিন বদলের গৌরবময় সাক্ষী হলো ইতিহাস। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে এই ইতিহাস ধারণ করা জরুরী। আর সেই অনুযায়ী স্নাতক পর্যায়ের সকল ধারার ছাত্র ছাত্রীর জন্যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষাক্রমটি অন্তর্ভুক্ত করা, সরকার তথা নীতিনির্ধারকের সঠিক সিদ্ধান্ত ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করি।
বইটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলার নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস, বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সহ সামগ্রিক জীবন ধারার প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন- এই শিক্ষাক্রমের (বইয়ের) প্রথম দিকে দেশ ও জনগোষ্ঠির পরিচয় সম্পর্কিত সংযোজিত অধ্যায়ে, বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে ভ’প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, নৃতাত্ত্বিক গঠন, ভাষা পর্যায়ে শিক্ষার্থী তথা ছাত্রছাত্রীরা বাঙ্গালী জাতির শিখর সম্পর্কে জানতে পারবে। এরপর উপমহাদেশের বিভক্তি পর্যায়ে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে লাহোর প্রস্তাব, ৪৭ সালে দ্বিজাতির তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান সৃষ্টি পর্যন্ত বিস্তৃতবিষয় জানতে পারবে। তবে তখনকার সময়ে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ব্যাপক ভাবে বলা হলেও, বৃটিশ যে তাদের নিজেদের স্বার্থে কৌশলগত কারনে এর বীজ বপন করেছে, সেই বিষয়টি নিয়ে উভয় ধর্মের সমান ভাবে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হলে, সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে পারষ্পরিক বিশ্বাস, আস্থা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পেত।
যাহোক, এরপর চমৎকার ভাবে পাকিস্থান রাষ্ট্রকাঠামো ও বৈষম্য সম্পর্কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পটভুমি ও বাঙালি আত্মপরিচয় প্রতিষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পাকিস্থানের সামরিক শাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে, বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ও আগরতলার মামলা বিষয়ক ঘটনা উঠে এসেছে। এরপর ৬৯ এর গণঅভ্যুখান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীর চাহিদা ভিত্তিক বিষয়বস্তু সংযোজিত হয়েছে। সবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল ও সপরিবারে হত্যা সম্পর্কে বিষয়বস্তু সংযোজনের মধ্যদিয়ে স্নাতক পাস ও স্নাতক সম্মান শ্রেণীর, সকল ধারার শিক্ষার্থীর জন্যে রচিত আবশ্যকীয় এই শিক্ষাক্রম সমাপ্ত হয়েছে। তবে এখানে আর্যদের যুগ থেকে শুরু করে, বিভিন্ন রাজা মহারাজার যুগ, এরপর মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক ১৭ জন সৈন্য নিয়ে ১২০৪ সালে বাংলা বিজয়ের মধ্যদিয়ে সুলতানী আমল প্রতিষ্ঠা ও এরপর মোঘল, ইংরেজ শাসনের ধারাবাহিকতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি অধ্যায় সংযোজিত হলে আরো সমৃদ্ধ হত এবং আরো বেশী কিছু হয়ত জানতে পারতো। এছাড়া অবিসংবাদিত বিশ্ববরেণ্য নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত যে চির অবিস্মরণীয় অবদান ছিল, তা আরো ব্যাপক ভাবে, আরো বিস্তৃত ও গুরুত্বসহকারে আলোচনা হলে, হয়ত এই মহান নেতা সম্পর্কে আরো বেশী কিছু জানতে পারতো।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে, সংক্ষিপ্ত আকারে যেসব ইতিহাস বা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ থাকে, তা ঐ বয়সে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর অনুধাবনের ক্ষমতা হয়ত পুরোপুরি থাকে না। আবার ৯ম শ্রেণী হতে বিভিন্ন ধারায় অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগে বিভক্ত হওয়ায়, সকল ধারার সকল শিক্ষার্থীর, সমান ভাবে পূণাঙ্গ ইতিহাস জানার সুযোগ হয়না। তাই এই অবস্থায় উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রথম সিঁড়িতে, অর্থাৎ স্নাতক ১ম বর্ষে, অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থী সঠিক ইতিহাস জানার স্বার্থে এই জাতীয় পাঠ্যবইয়ের খুবই গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া এই বই, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকেও সঠিক ইতিহাস জানতে এবং দেশাত্ববোধে আরো উদ্বুদ্ধ হতে সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি।
লেখক- শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক