স্কুল-মাদ্রাসা নির্বিশেষে একই ধারার শিক্ষা নিশ্চিত করে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ আইনে সরকারের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তুলে দেয়া হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থা। তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর উন্নীত এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ করার বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে এতে। খসড়ায় প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির বয়স ৪ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ জনগণের মতামত নিতে মঙ্গলবার খসড়াটি ওয়েবসাইটে (www.moedu.gov.bd) প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত info@moedu.gov.bd এবং law-officer@moedu.gov.bd ই-মেইলে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের ওপর মতামত দেয়া যাবে। প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য রোধে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ফি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি ও পদোন্নতির বিধান আছে। শিক্ষকদের নন-ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি এবং শিক্ষার বাইরে শিক্ষকদের অন্য কাজে না লাগানোর বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। প্রশ্ন ফাঁস এবং টিউশন-কোচিং বন্ধে কঠোর কোনো নির্দেশনা নেই এতে।
ক্লাসে পাঠদান নিশ্চিত না করলে বা শিক্ষকরা শিক্ষা আইনের ধারা লংঘন করলে কোনো শাস্তি দেয়া হবে কিনা- সে বিষয়েও কোনো নির্দেশনা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আয়সহ নানাভাবে যে হারে অর্থ কামাইয়ের নেশায় নেমে পড়েছেন, তাদের আইনের অধীনে আনা না হলে এ অপরাধ ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাবে। স্কুল ও মাদ্রাসায় একই ধারার শিক্ষা প্রবর্তনের লক্ষ্যে আইনের খসড়ায় অভিন্ন আবশ্যিক বিষয় বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ধর্ম ও নৈতিকতাসহ ৬ থেকে ৮টি বিষয় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন থাকবে।
প্রস্তাবিত আইনানুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা রাষ্ট্রের ব্যয়ে পরিচালিত হবে। এতে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা একটি যুগোপযোগী ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য আইন করতে চাই। শিক্ষা আইন ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন দরকার। তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে মতামত দিয়ে সহায়তার আহ্বান জানান। খসড়া আইন অনুযায়ীম প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম ও এবতেদায়ি মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। এ বিধান লংঘন করলে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া বিদেশী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী কোনো শাখাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন নিতে হবে। বিদেশী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় ও লেভেল এবং এ লেভেল বা সমপর্যায়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা করা যাবে। এক্ষেত্রে সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের (সরকারের) অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই প্রকাশ করা যাবে না। এ আইন ভাঙলে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডের কথা এ খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তোলার জন্য ৪ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের ২ বছর মেয়াদে বিদ্যালয়ে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষা হবে প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত হবে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর। মাদ্রাসা শিক্ষায় সাধারণ ধারার মতো ৪ বছর মেয়াদি ফাজিল অনার্স এবং ১ বছর মেয়াদি কামিল কোর্স ক্রমান্বয়ে চালু করা হবে। একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে খসড়ায়। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন করবে বলেও খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার মানোন্নয়নে ও যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। খসড়ায় মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-শিক্ষক পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস অথবা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে বা সহায়তা করলে সর্বোচ্চ ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে শিক্ষা আইনের খসড়ায়। ১৯৮০ সালের এ সংক্রান্ত আইনে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ১০ বছরের শাস্তির বিধান ছিল যা ১৯৯২ সালে সংশোধন করে সাজা ৪ বছর করা হয়। নবম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষা পাসের সনদ এবং একাদশ বা আলিম শ্রেণীতে ভর্তিতে এসএসসি বা সমমানের সনদ দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২৫ পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের পাঁচটি অধ্যায়ের ৬৯টি ধারা রয়েছে। এছাড়া প্রায় ৩শ উপধারা আছে।