মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রচন্ড দায় নিয়ে দিনের শুরু আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে দিনের শেষ হওয়াই জীবনের চরম বাস্তবতা। এই কঠিণ বাস্তবতা কোমলমতি শিশু-কিশোর ও সংসারের বয়োজেষ্ঠ্যদের চরমভাবে বঞ্চিত করে পারস্পরিক ভালোবাসা থেকে। যার ফলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্থ, তৈরি হয় নানান ধরনের পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জটিল মানসিক সমস্যার। অনেকক্ষেত্রে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে না পারার অপরাধবোধে দিশেহারা থাকেন অনেক মা-বাবাই। তাই শাসন-আদর, চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশার সমন্বয়হীনতা যে সমস্যার সৃষ্টি করছে, তা পরিবার, সমাজের গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে অনেক সময়। যদি বাড়িয়ে না বলি, বৃদ্ধাশ্রম, তরুণ তরুণীর সন্ত্রাসী র্কমকান্ড জড়িয়ে পড়া, নেশায় আসক্ত হওয়া, সন্তানদের পিতা-মাতার সাথে র্দুব্যবহার ও নৃশংসতা এর এই অপ্রাপ্তি থেকে জন্ম হয়। বেশির ভাগেই এর উৎপত্তি পারিবারিক অন্তোষ থেকে। পিতা-মাতার সন্তানদেরকে সময় দান এ সমস্যার অনেকটাই লাঘোব করতে পারে। কিন্তু প্রাত্যহিক এত কাজের ভিড়ে তা কি আদৌ সম্ভব! ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের কিভাবে একটু বেশি সময় দেয়া যায় তার কিছু টিপস আলোচনা করা হল –
রাতে একসাথে খাওয়া ঃ
সারাদিন কাজ থাকলেও সন্ধ্যার পর কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যায়। দিনের কাজের তালিকায় পরিবারের সদস্যদের সাথে খাওয়ার বিষয়টিও তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। খাবার টেবিলে এক সাথে হলে পারিবারিক বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান এখানেই হতে পারে যা পারিবারিক সর্ম্পককে সুদৃঢ় করে। এছাড়াও এক সাথে খাওয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্য সহজ সর্ম্পকের উন্নয়ন ও পরস্পরকে বুঝতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর কোনো কারণে যখন আপনি দূরে থাকছেন পরিবারের লোকেরা আপনার অনুপস্থিতিকে উপলব্ধি করছে। পরিবাররে সদস্যদের কাছে থেকে এ অনুভূতি সত্যিই উপভোগ্য।
পারিবারিক বিষয়ে সবাইকে চিন্তার সুযোগ দেয়া ঃ
বাড়ির রান্না ঘর থেকে শুরু ঘরে কি রঙ দিতে হবে, বাড়ির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য কী করা যেতে পারে, বাগানে কী ধরনের ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে, বাড়ির ছাদকে কিভাবে ব্যবহার করব ইত্যাদি পারিবারিক কাজে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পারিবারিক পরিবেশকে উন্নত ও টেকসই করে।
কাজের ফাঁকে এসএমএস পাঠান ঃ
বাচ্চা থেকে শুরু করে বড়রা সবাই উপহার পছন্দ করে। সকালে যদি তাদের সাথে দেখা না হয়, তবে একটি ছোট পারিবারিক ভিডিও বা একটি এসএমএস পাঠানো যেতে পারে। যার মাধ্যমে তারা আপনাকে খুঁজে নিতে চাইবে, আপনার অভাবকে অনুভব করবে। এখানে আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন তাদের মধ্য আপনি উপস্থিত থাকতে না পেরে কষ্ট পাচ্ছেন।
সবাই মিলে বই পড়া ঃ
প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা সময় সবাই মিলে বই পড়ে ব্যয় করা পরিবারের সাথে উত্তম সময় কাটানোর একটি অভিনব পন্থা। বই বাছাই, পড়া ও আলোচনা, অভিজ্ঞতা ও চিন্তার শেয়ার উন্নত পারিবারিক কাঠামোর সৃষ্টি করে।
বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ঃ
বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও স্কুল থেকে নিয়ে আসার মাধ্যমে এদের সাথে অনেকটা সময় ব্যয় করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এর মাধ্যমে বাচ্চারা কেমন বন্ধুদের সাথে মিশছে তারা আপনার বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর কি না সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন। বাচ্চারা সব সময় অতি মাত্রায় অনুকরণপ্রিয় ও সংবেদনশীল।
ঘুরতে বের হওয়া ঃ
সুযোগ থাকলে সপ্তাহে একবার নাহলে প্রতি মাসে অন্তত একবার নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা রাখা যেতে পারে। বিশেষ করে স্তান নির্বাচনে পরিবারের লোকজনের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। ভ্রমণ বাচ্চাদের বাহিরের পরিবেশের সম্পর্কে ভাল ধারনা তৈরি হয়।
পরিবারের সুখ-দুঃখের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ঃ
পারিবারিক ঐতিহ্য, ছবি ও ইতিহাসের সাথে পরিবারের লোক ও শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। ইহা সম্পর্ক উন্নয়ন ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সহায়ক। এছাড়া পরিবারে ছোটদের সাথে গল্প করার সুযোগ দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে এক সাথে বেড়াতে যাওয়া ভালো একটি সুযোগ হতে পারে। কথা বলার ও শেয়ার করার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে পারিবারিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। সুতারাং কাছাকাছি হওয়ার এই কৌশলকে পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ছোটদের দিয়ে ভাল কাজ করানো ঃ
ছোটরা সব সময় ভালো কিছু করতে চায়। আর এই ভালো সহযোগিতামূলক হলে আরো ভালো। ছোট শিশুকে দিয়ে একজন ভিখারির হাতে খাবার, টাকা-পয়সা তুলে দিন, বাচ্চার মনে পরিবর্তন হবে। আর দেখবেন আপনার মনে তৃপ্তি ও প্রশান্তি আসবে। অনুভূতিগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন।
পারস্পরিক সম্মান দেখানো ঃ
শিশুরা ভুল করবে। এইটা স্বাভাবিক বিষয়। তার ভুলটাকে ভুল না বলে একটু উৎসাহ দিয়ে সঠিক কাজটা তাকে দেখিয়ে দিন। এতে করে সম্মানবোধ বাড়ে। কৌশল বিনিময়ের ক্ষেত্রে সালামের আদান প্রদান করতে পারেন।
ভাল কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার ঃ
আপনার জীবনের ভাল কোন সফলতা ও ব্যর্থতা তুলে ধরুন। এতে করে অন্যরা নিজের জীবনের প্রতি যতœবান ও দায়িত্বশীল হবে।
ছোটদের পরিবারের বয়স্কদের সাথে কথা বলান ঃ
পরিবারের বয়স্কদের সাথে বাচ্চাদের কথা বলান বা মাঝে মাঝে ফোন ধরিয়ে দেয়া। যা আপনার বাচ্চাদের বড়দের সম্মান করতে সেখাবে। তাদের বাসায় বেড়াতে গেলে কিভাবে বড়দের শ্রদ্ধা করতে তা শিখিয়ে দেন। এতে তাদের কাছে আপনারও সম্মান বৃদ্ধি পাবে।
সবাই মিলে একদিন রান্না করুন ও খাওয়া-দাওয়া করুন ঃ
সপ্তাহে বা মাসে একদিন সবাই মিলে বাড়িতে কিছু রান্না করে খাওয়া বা সবাই মিলে বিশেষ কিছু খেতে যাওয়া। যা পারিবারিক পরিবেশকে সুন্দর করে।
নতুন কিছু শেখা ঃ
পরিবারের সবাই মিলে নতুন কোনো শখ বা নতুন কোন কাজ করুন। যেমন সবাই মিলে নতুন ভাষা, গান, কোরআন ও গাড়ি চালানো ইত্যাদি শেখা যেতে পারে। কেউ শেখালে ও কেউ শিখলে পারিবারিক হৃদ্যতা তৈরি করে।
সবাই মিলে আড্ডা দেয়া ঃ
পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দিন। এখানে আলোচনা হবে প্রত্যেকটা দিন কে কিভাবে কাটাচ্ছে, কার কী সমস্যা, প্রত্যেকে নিজেদের সাথে সহজ ও সাধারণ বিষয় নিয়েও আলোচনা করতে পারে। প্রত্যেকেই যখন সবাই সবাইকে জানতে পারবে উপলব্ধি করুন জীবনটা এখন কত উপভোগ্য। উল্লেখ্য, পারিবারিক বেশিরভাগ সমস্যাই নিজেদের না জানা ও না বোঝার কারণে সৃষ্টি হয়।
খাবার ভাগ করে খান ঃ
সবাই মিলে এক টেবিলে খান অথবা কম খাবার সবাই মিলে ভাগ করে খান। সবার পছন্দের খাবার এক জায়গায় করে সবার খাবার সবাই মিলে খান, জীবনের অর্থের পরিবর্তন হয়ে যাবে।
পারিবারিক বিশেষ দিনগুলোকে সবাই মিলে উদযাপন করুন ঃ
বিভিন্ন উপলক্ষে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাধ্যমতো উপহার দেয়া নেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারে। এটা জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মীয় অনুশাসন চর্চা করুন ঃ
ধর্ম মানুষকে সামাজিক করে, জীবনকে বুঝতে শেখায়, পরিবারের সবাই মিলে পালন করে সবাইকে কাছে নিয়ে আসে। জামাতে নামাজে দাঁড়ান, জানাজায় যাওয়া, বড়দের শ্রদ্ধা করা, ছোটদের ¯েœহ করা, পরিবারের লোকদের মানসিক চাপ কমিয়ে প্রশান্তির পরিবেশ তৈরি করে।
পরিশেষে বলা যায়, বাস্তবতা যতই কঠিন হউক একটু আন্তরিকতা, একটু ভালোবাসা দেখান, একটু পরিবারের সাথে সময়দান অতৃপ্তির কঠিন দেয়ালকে ভেঙে উপভোগ্য জীবন এনে দিতে পারে। যে পরিবারের সুখের জন্য এত বেশি পরিশ্রম করেন, আর এই অতিরিক্ত পরিশ্রমই যদি আপনার পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়, তবে এই পরিশ্রমের কতটুকু প্রয়োজন আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই আসুন সবাই মিলে পরিবারের সাথে বেশি বেশি সময় দিয়ে, সুন্দর জীবনের অনিবার্য দাবি পূরণের চেষ্টা করি। সবাইকে ভাল রেখে বাচঁবো একসাথে।