৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সুইডেন রাজার কাছে এক ছোট্ট শিশুর হৃদয়কাঁপানো চিঠি

তুরস্কের সমুদ্র সৈকতের ছোট্ট  আলান কুর্দির মৃতদেহের ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল সারা পৃথিবীকে। আলানের বাবা আবদুল্লার মুখে শোনা গিয়েছিল সিরিয়া থেকে তাঁদের পালানোর গল্প। কিন্তু কুর্দি পরিবার তো একা নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে গত দু’বছর ধরে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হাতে করে পালিয়েছেন। জন্মভিটেতে কেমন ছিলেন তাঁরা? পরভূমে এসেই বা কেমন আছেন? এবার সেই গল্পই শোনা গেল অন্য এক আলানের কাছ থেকে।

[ad id=”28167″]

ছোট্ট আহমেদ। বয়স বারো। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাবা, মা আর ছোট্ট ভাইয়ের সঙ্গে শরণার্থী মিছিলে মিশে আহমেদ এসে পৌঁছেছিল সুইডেনের মালমো শহরে। ভর্তি হয় সেখানকারই সোফিলুন্ডস্কোলান স্কুলে। সেই স্কুলেরই কাউন্সিলর  পুজা শরাফিকে গিয়ে এক দিন তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল আহমেদ।

কী সেই ইচ্ছে? গল্প শোনাতে চায় আহমেদ। তবে যাকে-তাকে নয়, খোদ সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাফকে। কী গল্প? সেই অন্ধকার সময়ের গল্প, যখন সে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল তার নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের বাড়ি ছেড়ে। আরবিতে লেখা সেই চিঠি পড়ে কেঁদে ফেলেন শরাফি। তিনিই চিঠিটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেন সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। চিঠি এখনও রাজা গুস্তাফের নজরে এসেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।

আহমেদের সেই চিঠি—

‘‘রাজা গুস্তাফ,

আমি আহমেদ, বয়স ১২। আমার বাবা, মা ও একটা ছোট ভাই আছে। আমাদের আলেপ্পোর বাড়িতে আমরা খুব মজায় ছিলাম, জানেন? বাবার একটা খুব বড় কারখানা ও দোকান ছিল, বাচ্চাদের জামা-কাপড়ের দোকান। বাবা আমায় অনেক খেলনা, অনেক উপহার এনে দিত। আমরা খুব আনন্দে ছিলাম। কিন্তু যুদ্ধের শব্দ এসে একদিন আমাদের সব আনন্দ কেড়ে নিল। বাবার কারখানাতেও কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিল। কারখানার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমস্ত খুশিও যেন উধাও হয়ে গেল। এরপর একদিন আমার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিছুতেই ওই মুহূর্তটাকে ভুলতে পারি না, যখন আমার চোখের সামনেই আমার মাস্টারমশাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হল। ওহ্?.. ওটা আমার জীবনের সব চেয়ে খারাপ মুহূর্ত!

বাবা একদিন এসে বলল, আমাদের কারখানাটা জ্বলছে। মা শুনে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাবা সে দিনই সিদ্ধান্ত নিল, বাঁচতে হলে আমাদের এই দেশ ছাড়তে হবে। সেই থেকেই আমাদের জীবনের সব চেয়ে খারাপ দিনগুলোর শুরু। শনিবার খুব ভোর থাকতেই আমরা তুরস্কের দিকে রওনা হলাম। একটা ভয়ঙ্কর ভাঙা নৌকোয় করে আমরা যাচ্ছি। চারপাশে শুধু জল আর জল। কী ভীষণ অন্ধকার। আমার খুব ভয় করছিল। সবাই চিত্কার করছে, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো কাঁদছে। বাবা কিন্তু পুরোটা সময় মুখে হাসি ধরে রেখেছিল। আসলে মনে মনে আমাকে আর ভাইকে সাহস দিতে চাইছিল। আমি কতবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হল? কোথায় গেল আমাদের বাড়ি, আমার বিছানা, আমার খেলনাগুলো!

অবশেষে আমরা দ্বীপটায় এসে উঠলাম। পুলিশ আমাদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল যেটা ওই রবারের নৌকোটার চেয়েও খারাপ। চারপাশে কত লোক! কী বিচ্ছিরি গন্ধ! আমাদের এখন এখানেই থাকতে হবে, যতক্ষণ না পুলিশ আমাদের ছাড়ছে। পনেরো দিন আমাদের কোনও ঘর ছিল না। সেই দিনগুলোয় কী ভীষণ মন খারাপ করত আমার।

তবু আমি কখনই মা-বাবার সামনে কাঁদতাম না, কারণ আমি ওদের কষ্টটাকে বাড়াতে চাইনি। আমি দেখেছি, মা-ও আমার মতোই সবাইকে লুকিয়ে একা একা কাঁদত। তখন আমার কী যে কষ্ট হতো! এর পর আমরা সুইডেনে এলাম। আমি এখানকার রাজার সঙ্গে, মানে আপনার সঙ্গে, দেখা করতে চাই, শোনাতে চাই আমার সব গল্প। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় আমি একটা ব্যাগে করে কয়েকটা নতুন জামা নিয়ে এসেছিলাম। ওগুলো পরেই আমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

এখন আমরা সুইডেনে। এখানে মাসির কাছে একটা ছোট্ট ঘরে থাকছি আমরা। আমাদের তো কী সুন্দর বড় একটা বাড়ি ছিল। সিরিয়ায়। এখন আমি প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা আমার সামনের জানালায় দাঁড়িয়ে। হায়! বাবার কাছে এখন আর অত পয়সা নেই যে, আমরা যা চাইব তাই এনে দেবে। তাই, আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতেই হবে, রাজা! আমি যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব, আমার খুব ইচ্ছা নতুন জামা পরে যাই, যেগুলো আমি বাড়ি ছেড়ে আসার সময় ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম, খুব সাবধানে।’’

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ