সবুজ মন্ডল
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন, সেই মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার প্রতিটি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।উত্তাল মার্চের সেই সময়টায় জাতির পিতার এই উজ্জীবনি ডাক বাংলার সাধারণ মানুষের মতো সীতাকুণ্ডবাসীর মনেও ‘স্বাধীন বাংলার’ স্বাদ জাগায়।২৬ মার্চ খবর ছড়িয়ে পড়ে,উত্তরদিক থেকে পাকবাহিনী চট্টগ্রাম আক্রমণে আসছে।নিজের জন্মভূমিকে রক্ষার তাগিদে নিরস্ত্র সীতাকুণ্ডবাসীও তীব্র মনোবলের জোরে প্রস্তুত হতে থাকে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে।জরুরী অবস্থা মোকাবিলায় ছাত্র-যুবক-কৃষক সহ সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে গঠন করা হয় অ্যাকশন কমিটি,যার আহবায়ক করা হয় ডাঃ আকতার-উজ-জামানকে।ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত হয়ে অ্যাকশন কমিটির
সদস্যরা প্রতিহত করতে থাকে পাক হায়েনাদের।সর্বশেষ,মধ্য এপ্রিলে ফসিউল আলমের নেতৃত্বে সৈয়দ আবুল হোসেন সহ নেতৃস্থানীয় সদস্যদের সহযোগিতায় সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকা রাজাকারদের মাইক্রোওয়েভ কেন্দ্রটি আক্রমণ করা হলে রাজাকার ও পাঞ্জাবীরা পালিয়ে যায়।দীর্ঘপ্রতিক্ষার পর বাঙ্গালী জাতি ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়।কিন্তু সে বিজয়ের স্বাদ দীর্ঘস্থায়ী হবার পূর্বেই ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে রচিত হয় আরেক কলংকিত অধ্যায়।পরবর্তিকালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবর্তে রাজনৈতিক অস্থিরতাই জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।
মী জনতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটে। মুক্তি পায় গণতন্ত্র।১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ সরকার।তবে তার এই অযাচিত ক্ষমতাদখল দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠে নি।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটে। মুক্তি পায় গণতন্ত্র।১৯৮২ সাল থেকে ‘৯০ এর পূর্ব পর্যন্ত এরশাদ সরকার দেশের রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে গণবিরোধী এক ধারার প্রবর্তন করে। রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হন।সামরিকজান্তার সেই রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে একবুক সাহস নিয়ে রাজপথে নামেন মরহুম সৈয়দ মো: আবুল হোসেন।রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করার জন্যে নিজের পৈত্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলেন আওয়ামীলীগের অস্থায়ী কার্যালয়।’৭১ এ সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া টগবগে এই যুবকের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি, সীতাকুণ্ড পৌরসভার মধ্যম মহাদেবপুর(ভূঁইয়া পাড়া)গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে।তৎকালীন সময়ের নামজাদা ব্যবসায়ী মরহুম আবদুর রউফ সওদাগর এবং মা সুরুজ্জমানের ঘরে চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি।
‘৭৫ পরবর্তি সময়ে মানুষ যখন আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে ভয় আর শঙ্কা ঠিক তখনি এই মানুষটিই কাণ্ডারী হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকায় তুলেছিলেন একেকজন কর্মীকে। সংগঠনের পেছনে সব উজার করে দিতেও কখনো পিছপা ছিলেন না উদারচেতা এই মানুষটি।কারণ তিনি ভেতর থেকে বিশ্বাস করতেন,আমি কর্মীদের জন্য একবুক নামলে,কর্মীরা অন্ততঃ একহাঁটু নামবে।উদ্যোম আর অদম্য সাহসিকতায় ভরা এ মানুষটি নিজের যোগ্যতাবলে আশির দশকে সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি এবং ১৯৯২-৯৬ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদে অধিষ্ঠ হন।রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নিজেকে একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।সাংগঠনিক জীবনে তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও।সীতাকুণ্ড বর্ণালী ক্লাবের আজীবন সদস্যও ছিলেন তিনি।তাঁর সমাজ সেবার নজির এখনো পাওয়া যায় মহাদেবপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের মুখে।ক্ষমতার বাইরে থেকে যে মানুষটি দলকে মাঠপর্যায়ে গুছানোর জন্য এত ত্যাগ আর শ্রম দিয়েছেন,সেই মানুষটি ‘৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের মাস কয়েক আগে ১৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী অনুরাগী নেতাকর্মী,পরিবার-পরিজন সবাইকে ফেলে চলে যান-না ফেরার দেশে।
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের জানাজায় তৎকালীন উত্তরজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং বর্তমান গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিলেন,সীতাকুণ্ড আওয়ামী রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন এই মানুষটির শূন্যতা কখনোই পূরণ হবার নয়।
প্রবীণ-বিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা,সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মনিষ্ঠা,উদারচেতা মনোভাব তাঁকে সীতাকুণ্ডবাসীর মনে করে দিয়েছে এক অপূরণীয় স্থান।
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা,নিভৃতচারী সমাজসেবকের ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।