১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাত ব্যাংকে সালমানের ঋণ ৩৬ হাজার কোটি

সাত ব্যাংকে সালমানের ঋণ ৩৬ হাজার কোটি

শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, আরও পাঁচটি ব্যাংক নিজেদের  নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছেমতো লুট করে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ঋণের নামে পাচার করা এই টাকা ব্যাংকে ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো দেড় বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। কিন্তু সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিশেষ সুবিধা দিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছিলেন। এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সুবিধা কাটছাঁট করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ‘টাকা ছাপিয়ে’ ও নানা অভিনব সুবিধা দিয়ে এস আলম-নিয়ন্ত্রিত ছয়টি ব্যাংককে টিকিয়ে রেখেছিলেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সায় ছিল। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান সাবেক গভর্নর। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে দেওয়া বিশেষ সুবিধার সীমা কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের এক কোটি টাকার বেশি অর্থের চেক ক্লিয়ারিং করার সুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সাত ব্যাংকে সালমানের ঋণ ৩৬ হাজার কোটি

সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আইন। পর্যাপ্ত জামানতও নেই অধিকাংশ ঋণে।

সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ বের করেছেন। এই ব্যাংকে বেশিরভাগ ঋণই ছিল তার বেনামি। এতদিন তার নামে জনতা ব্যাংকে থাকা ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা দেখিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তার ২৯ প্রতিষ্ঠানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সারা দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান কালের   বলেন, ‘দুপুর দেড়টায় আমরা অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। অভিযোগটি নিবন্ধন বইয়ে নিবন্ধনভুক্ত করা হয়েছে। এই নিবন্ধনের মানে মামলা হয়েছে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই সময়ের পর থেকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দলটি ক্ষমতায় ছিল টানা ১৫ বছর ৭ মাস। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে তিনটি। সবগুলোই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যাপক আকার পেয়েছে দুর্নীতি, বাড়তে বাড়তে গোটা ব্যবস্থাকেই গ্রাস করেছে। আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয়ে পড়েছে দুর্নীতির সুরক্ষাদাতা। এক পর্যায়ে সরকারসংশ্লিষ্টরাও বুঝে যান, কোনো কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হলে তার মূল্য তাদের জন্য মারাত্মক হবে।

দিল্লিতে বসে হাসিনার বিবৃতি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর

পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বিবৃতি দিলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাংলাদেশ।

দিনভর সিরিজ ওই বৈঠকগুলো শেষে সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচায় উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে উপদেষ্টা বলেন, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিলে সম্পর্কের ক্ষতি হবে বলে আমরা হাইকমিশনারকে জানিয়েছি। আমি বলেছি- এটা সম্পর্ক উন্নয়নে মোটেও সহায়ক হবে না। এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের জবাব কী ছিল জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা আমাদের সরকারের অবস্থানটা স্পষ্ট করেছি।

পালাবদলে চাঁদাবাজি ও দখলের মচ্ছব

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ শুরু করেছে নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন সরকারের উপদেষ্টারাও। কিন্তু এসবে গা করছে না একটি গোষ্ঠী।

সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে তারা। কেউ চাইছে ঠিকাদারি, কেউ দাবি করছে চাঁদা, আবার কেউ ব্যস্ত চেয়ার দখল নিয়ে। ক্ষমতার পালাবদলে যেন দখলের মচ্ছব লেগেছে সর্বত্র।

বিশেষ আইনে বিপুল নয়ছয়

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন পাস হওয়ার পর বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত ১৩ বছরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) বাবদই গুনতে হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যদিও দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হলে বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হতে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ এবং এ খাতের কর্মকর্তারা।

তীব্র বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে একটি আইন করেছিল সরকার। এই আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবেও পরিচিত পেয়েছে। তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের পর ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা রয়েছে। গত এক দশকে বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তর দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে শতভাগ মানুষ। তারপরও আইনটি চালু রয়েছে এখনো।

তথ্য গোপন করে সরকারকে ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ

সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে দেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের এ ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, নতুন ঋণ না নিয়ে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা আগের দায় সমন্বয় করেছে। সরকার পরিবর্তনের পর তথ্য গোপন করে টাকা ছাপিয়ে এ ঋণ দেওয়ার ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।

সাধারণভাবে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যু করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়। গত বছরের জুনের আগ পর্যন্ত বিল ও বন্ডের নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর তা আরোপিত (ডিভল্বমেন্ট) হতো। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারকে দেওয়া ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দেয় ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হবে না।

শামসুল হক টুকু-পলক ও সৈকত গ্রেফতার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় আত্মগোপনে থাকাবস্থায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর পল্টন থানায় করা একটি মামলায় তাদেরকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বুধবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এসএমএসে তিনজনকে গ্রেফতারের তথ্য জানানো হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ভারতে পালানোর সময় জুনাইদ আহমেদ পলককে আটক করার খবর প্রচারিত হয়েছিল। একই দিন বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকেও। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে সে তথ্য প্রচার হয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের হেফাজতে নিয়েছিলেন। এরপর হঠাৎ করেই বুধবার রাতে ডিএমপি থেকে জানানো হয় নিকুঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এছাড়া  আন্দোলন মোকাবিলায় ভুল ছিল; গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না অনেক ব্যাংক; হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণকারী ও নির্দেশদাতা সবাই অপরাধী; ফাঁসছেন আ.লীগের শীর্ষ নেতারা—সংবাদগুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ