[english_date]

সাইক্লোন থেকে হারিকেন

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জমান মুজমদার

বিশ্বে প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে। সে সাথে মানুষও পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। মানববান্ধব আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য মিসর, মেটোপটেমিয়া ও ভারত বিশ্বের প্রথম বিশাল সভ্যতায় কৃষি ভিত্তিক রাষ্ট্রের রূপ নেয়। এটা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ অব্দের দিকের কথা । এরপর বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গোটা দুনিয়াব্যাপী আবহাওয়ার রূপ রূপান্তর অব্যাহত থাকে। সরবরাহকৃত তথ্য থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৪২০০ অব্দ নাগাদ জলবায়ুর এক আকষ্কিক বদল সারা বিশ্বে নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটনায় বিশ্বে আবহাওয়াগত মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে চলছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে সাইক্লোন থেকে হারিকেন শীর্ষক বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু নীতিশীতোষ্ণ। যদিও বাংলাদেশের দক্ষিণ ভাগ দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা গিয়েছে তবুও সমুদ্রের নৈকট্য ও অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের দরুণ কোথাও গ্রীষ্মের আধিক্য তেমন পরিলক্ষিত হয় না। ্অল্প কথায় বলা যায় যে, এখানকার জলবায়ু মোটামুটিভাবে উষ্ণ, আদ্র ও সমভাবাপন্ন। আমরা জানিযে, বার্ষিক বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জলবায়ুকে তিনটি ঋতুতে ভাগ করা যায়। যথা-শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা কাল। আলোচ্যাংশ বর্ষা গ্রীষ্মকালে প্রবাহিত সাইক্লোন বা হারিকেনই প্রাধান্য পাবে।
সাইক্লোন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ কুকলস থেকে। এর অর্থ ‘কুন্ডলী পাকানো সাপ।’ ইহা বঙ্গোপসাগরে উৎপত্তি হয়ে বাতাস ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়, তখন তা’ সাইক্লোন বা ঘূর্ণিবাত নামে আখ্যায়িত হয়। বলা বাহুল্য যে, সাইক্লোন বা ঘূর্ণিবাতই আটলার্ন্টিক মহাসাগরে ‘হারিকেন’ নামে পরিচিত। সুতরাং সাইক্লোন থেকেই হারিকেনের উৎপত্তি।
ছাত্র জীবনে প্রতিবছর মৌসুমী বায়ু কাকে বলে, কিভাবে কালবৈশাখী, হারিকেন বা সাইক্লোন, টর্ণেডো উৎপত্তি হয় কিংবা শীতকালে বৃষ্টিপাত কম হয় কেন? ইত্যাদি প্রশ্ন পরীক্ষায় থাকতো। ছোটকালে দেখেছিযে কাল বৈশাখী কিংবা সাইক্লোন শুরু হলে পার্শ্ববর্তী হিন্দু বাড়ির লোকজন উলুধ্বনি এবং মুসলমান বাড়ির লোকজন আজান দিত। স্পষ্ট মনে আছে, আমার স্বর্গবাসী ফুফু সাইক্লোন শুরু হলে তড়িঘড়ি করে শীল পাটার উক্ত বাইরে ফেলে দিতেন।
তাঁর বিশ্বাস ছিল শীল পাটার উহা বাইরে ফেলে দিলে সাইক্লোন ঘর-বাড়ির কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ফুকুর এ ধরনের আত্মবিশ্বাসের কথা মনে হলে মনের অজান্তেই আমার হাসি পায়। এবং ভাবি কত সহজ সরল ছিল তাঁরা।
আমরা বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে বাস করছি। জ্ঞানবান্ধব সমাজে রূপ কথা কিংবা কুসংস্কারে মানুষ বিশ্বাস করে না। গ্রামের সে খড়-কুটো, গুলপাতা ও শনের ঘর বর্তমানে নেই বললেই চলে। পাকা-আধা পাকা ঘর-বাড়ির সাথে রাস্তা হয়েছে সমতলে। এতদিনে সাইক্লোন থেকে হারিকেন কেন হয়? তাও আমরা জেনে গেছি। বিজ্ঞানীরা বলেন যে, সাগরের জল রাশি ঠিক উপরিভাগের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা কোন কারণে যদি বেড়ে যায়, তাহলে হালকা গরম বাতাস দ্রুত গতিতে উপরে উঠে যায় এবং ঐ শূন্যস্থানটির বায়ু চাপ কমে যায়। তখন চারপাশ থেকে অপেক্ষাকৃত শীতল ও ভারি বাতাস এসে জায়গাটি পূরণ করে। ভারি বাতাসের নিচের দিকের এ গতিপ্রবাহকে নি¤œ চাপ বলে। এ নি¤œচাপ সময়ের সাথে সাথে শক্তি সঞ্চয় করে। ক্রমান্বয়ে তা’ ভয়ঙ্কর শক্তি পেয়ে কোনো একদিকে চলতে শুরু করে। প্যারেলের সূত্রানুসারে সাইক্লোনের বাতাস উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে চক্রাকারে কেন্দ্রের চারদিকে প্রবাহিত হয়। সাইক্লোনের রাহুগ্রাসে ল-ভ- হয়ে যায় দুনিয়ার সকল কিছ্।ু ব্যাপক প্রাণহানী ও ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মুহূর্তে প্রবাহিত সহিক্লোন আমাদের নিকট বিনা মেঘে বজ্রাঘাত তুল্য। অথচ, শুনতে অদ্ভূত হলেও সাইক্লোন বা হারিকেনের নামের সঙ্গে যুক্ত আছে রহস্যময় কল্পকাহিনী নারী-পুরুষ ও প্রেমিক-প্রেমিকার নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে তো মেনে নেয়া যায় কিন্তু নাম যদি পশু-পাখির সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়, তা কি মেনে নেয়া যায়? ন্যায়-নীতি, ভাল-মন্দ কিংবা খলনায়ক বা স্বৈরশাসকের নামের সহিত মিল রেখে সাইক্লোন কিংবা হারিকেন অথবা এ জাতীয় ধ্বংসাত্মক বজ্রপাতের নাম হলে সত্যিই মন্দ হতো না। কিন্তু আবহাওয়াবিদরা সে পথে হাঁটেন নি।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এদেশে প্রতি বছর বর্ষা-গ্রীষ্মকালে বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দ্বীপাঞ্চলে বেশুমার লোকজনের প্রাণহানী ঘটে। গরু-গাছল-পশু-পাখি ও অর্থনৈতিক সম্পদের বিশেষ করে মৎস্য জাতীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তাই এদেশে বর্ষা ও গ্রীষ্মকাল মানেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাস। দেশবাসীর নিকট আতঙ্কের মাস। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের নাম শুনলে এখনো লোকজন অজানা আতঙ্কে থাকে। সারাদেশে সাইক্লোনের মতো অতিশয় ভয়ঙ্কর দৈত্যের ছোবল থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত বেড়িবাঁধ ও সাইক্লোন সেন্টার গড়ে উঠেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে উপকূলীয় অঞ্চলে যে সব সাইক্লোন সেন্টার গড়ে ওঠেছে তা অপর্যাপ্ত ও অরক্ষিত। বৈরী আবহাওয়ার সময় কোন কোন সেল্টার কেন্দ্র ব্যবহার উপযোগী থাকে না। প্রতিটি ধর্মালয় কেন্দ্রিক সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ এবং এগুলো দেখভাল করার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত হওয়া উচিত। নারী-পুরুষ, জীবজন্তুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা এবং বৃদ্ধ ও শিশু ও প্রসূতির জন্য ডাক্তার-কবিরাজসহ তাদের সেবা-যতেœর জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থাপনা সাজিয়ে রাখা দরকার। যাতে দুর্যোগকালীন জনগণকে আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে না হয়। যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্থানীয়জনগণ যাতে সাইক্লোন বা হারিকেনের সময় আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নির্মিতগুলোর আশু সংস্কার এবং চাহিদামত আরো সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা।
সাইক্লোন, হারিকেন, টর্ণেডো, রিটা, ক্যাটরিনা, নার্গিস, সিডর, রেশমিও বিজলী নারীর নামে সাথে মিল রেখে নামকরণই যথেষ্ট নয়। সে সাথে চাই এ সকল নামের সুন্দর ব্যবহার। দেশের জনগণকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকের ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য আধুনিক ব্যবস্থাপনার স্পর্শে অত্যাধুনিক সাজ-সরঞ্জামের আগাম ব্যবস্থা থাকা চাই। একজন অস্ট্রেলিয়ান আবহাওয়াবিদ সাইক্লোনের নামকরণ করেছিলেন তার অপছন্দের রাজনীতিবিদদের নামে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সময়ে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের সাইক্লোনের নাম দেয়া হয় ফোনোটিক হরফ ব্যবহার করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমরবাহিনীরা দেন মেয়েদের নাম এবেল, বেকার চার্লি ইত্যাদি। যাক, চাঁদকে আমি চাঁদ এবং সাইক্লোনকে-সাইক্লোনই দেখি। তাই চাঁদকে উপভোগ এবং সাইক্লোনকে দুর্যোগ হিসেবেই জানি। তাই বলি সাইক্লোন থেকে হারিকে ও এক বাহুবিধ নামে মধ্যে ইহা যে নামেই বাংলাদেশে প্রবেশ করুক এর কড়াল ছোবল থেকে দেশের মানুষ, জীব-জন্তু, ঘর-বাড়ি ও সহায় সম্বল রক্ষা করার জন্য কর্তৃপক্ষসহ সমাজের সবাইকে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। কারণ আবহাওয়াবিদ ও ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের দেশে বছরে ন্যূনতম একবার হলেও সাইক্লোন বা হারিকেন আসবেই। পরিশেষে আমার ফুফুর শ্লেক দিয়েই শেষ করি। আল্লারে কালা মেঘে করলরে অন্ধকার ভাননেই বাতাস নেইরে দোলাইলো সংসার।’

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ