মানব সমাজে নারী জন্মের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কন্যা সন্তানের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার পর ইসলাম সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও নারী- পুরুষকে সমান ঘোষণা করেছে। জন্মগতভাবে নারী-পুরুষ আল্লাহর কাছে সমান বলে, নারীকে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষ ঘোষণা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ঘোষণা করেছে,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক উৎস থেকে। আর তা থেকে তোমাদের স্ত্রীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। এরপর তা থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।” (সূরা নিসা, আয়াত ০১)অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। (সুরা আল-হুজরাত: ১৩)আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ ও সফল হওয়ার মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতিকে। তাই একজন নারী একজন পুরুষ হতেও শ্রেষ্ঠ হতে পারে। উপরের আয়াতে এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম:
নারী-পুরুষ বালেগ হওয়ার পর উভয়েই উভয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু এটি যেনো তেনোভাবে না করে এজন্য ইসলাম বিবাহের মতো সুন্দর একটি বিধান দিয়েছে। আর এই বিবাহের মাধ্যমে আসলে মূলত: ইসলাম নারীদেরকেই লাভবান করেছে। দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদার এক শীর্ষ চূড়া। বিবাহ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا
“তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বানিয়েছেন তার সঙ্গিনীকে, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আরাফ, আয়াত ১৮৯)বিবাহের মাধ্যমে মানুষ তাদের প্রাকৃতিক চাহিদা বৈধ পন্থায় পূর্ণ করে। পারিবারিক জীবনে প্রশান্তি লাভ করে। ইরশাদ হয়েছে:
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। (সুরা রূম: আয়াত ২১)আরো ইরশাদ হয়েছে,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً
“আর অবশ্যই তোমার পূর্বে আমি রাসূলদের প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে দিয়েছি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। (সুরা রা’দ: আয়াত ৩৮)অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে:
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্যে পরিধেয় আর তোমরা তাদের জন্যে পরিধেয়।” (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)বিবাহের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নারী পুরুষের ইজ্জত-সম্ভ্রম হিফাজত হয়। পারিবারিক শান্তি ও সুন্দর জীবন লাভ করা যায়। এছাড়াও বিবাহের মাধ্যমে সামাজিক পর্যায়ে অনেক সুফল পাওয়া যায়। এজন্যেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর ভরু-পোষণ দিতে সক্ষম সকল যুবককে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
عن عبد الله بن مسعود قال لنا رسول الله صلى الله عليه و سلم ( يا معشر الشباب من استطاع الباءة فليتزوج فإنه أغض للبصر وأحصن للفرج ومن لم يستطع فعليه بالصوم فإنه له وجاء
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের ভরু-পোষণের সক্ষমতা রাখে তারা যেন বিয়ে করে ফেলে। কেনন এটা চোখের প্রশান্তি দানকারী ও লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। আর যারা স্ত্রীদের ভরু-পোষণের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন রোজা রাখে, কেননা এটা তাদের উত্তেজনাকে হ্রাস করবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭৭৮)যুবকদেরকে বিবাহের ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য বিবাহের ফজীলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন,
إذا تزوج العبد فقد استكمل نصف الدين فليتق الله في النصف الباقي
“হযরত আনাস রা. থেকেব বর্ণিত, যখন কোন ব্যক্তি বিবাহ করে, তখন সে যেন তার অর্ধেক ঈমানকে পূর্ণ করে ফেললো। এখন বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।” (মিশকাত শরীফ: হাদীস নং ৩০৯৭)স্ত্রীদের গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
المرأة الصالحة من السعادة
“উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যর পরিচায়ক।” (মুসলিম শরীফ)বৈরাগী জীবনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
تَزَوَّجُوا فَإِنِّى مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ وَلاَ تَكُونُوا كَرَهْبَانِيَّةِ النَّصَارَى
“আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমরা বিবাহ কর, কেননা আমি তোমাদের নিয়ে উম্মতের আধিক্যের উপর গর্ববোধ করব। এবং তোমরা খৃষ্টান বৈরাগ্যদের মত হয়ো না।” (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী)পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ পুরুষদেরকে নেককার স্ত্রী ও নেক সন্তান কামনা করা শিখিয়েছেন এভাবে,
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ
“আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে।” (সুরা ফুরক্বান, আয়াত ৭৪)অধিক খরচের গ্যারাকলে পরে পুরুষরা যেনো বিবাহ বিমুখ না হয়, সেজন্য ইসলাম বিবাহের ক্ষেত্রে বাহুল্য খরচ বর্জনের কথা বলেছে। বাহুল্য খরচ বর্জিত বিবাহকেই সবচেয়ে বেশী বরকতপূর্ণ ও উত্তম বিবাহ বলে ঘোষণা করা হয়েছে হাদীসের মাঝে। ইরশাদ হয়েছে,
إن أعظم النكاح بركة أيسره مؤنة
হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি বরকত ও কল্যাণময় বিবাহ হচ্ছে সেটি, যেখানে খরচ কম হয় (অহেতুক খরচ হয় না)।” (বায়হাকী, ঈমান অধ্যায়)বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়েই নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করলেও ইসলাম নারীদের জন্য বোনাস পাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। পুরুষের উপর বিবাহের সময় স্ত্রীদের জন্য মহর দেয়া ফরজ করেছে। ঘোষণা করেছে,
انْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“সুতরাং তোমরা তাদেরকে তাদের অভিভাবকদের অনুমতিক্রমে বিবাহ কর এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ২৫)অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً
“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সূরা নিসা: আয়াত ৪)বিবাহের পর স্ত্রীদের সাথে সর্বদা সদাচারণ বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে ইসলাম ঘোষণা করেছে,
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“আর তোমরা তাদের সাথে সদাচারণ করো।” (সূরা নিসা: আয়াত ১৯)নিজে ভালো খাবে, উত্তম পোষাক পড়বে আর স্ত্রীদেরকে নিম্ন মানের জীবন ধারণে বাধ্য করার জাহেলি মানসিকতাকে সমূলে বিনাশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنْتُمْ مِنْ وُجْدِكُمْ
“তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেখানে তোমরা বসবাস কর সেখানে তাদেরকেও বাস করতে দাও।” (সূরা তালাক, আয়াত ৬)নারীর নিজের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি সন্তানের দায়িত্বও স্বামীর কাঁধে তুলে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ
“বিত্তশালীরা যেনো সামর্থানুযায়ী স্ত্রী-সন্তানের উপর ব্যয় করে। সীমিত উপার্জনকারীরা আল্লাহর দেয়া অর্থানুপাতে ব্যয় করবে।” (সূরা তালাক, আয়াত ৭)পুরুষদের উপর নারীদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা করেছে,
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِى عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكُيمٌ
“নারীদের উপর যেমন তোমাদের কিছু অধিকার রয়েছে ঠিক তেমনি তোমাদের উপরও তাদের কিছু অধিকার রয়েছে। স্ত্রীর উপর পুরুষের মর্যাদা। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারা : আয়াত ২২৮)নারীদেরকে দূর্বল ও অসহায় পেয়ে যাতে করে কেউ তাঁদের উপর জুলুম ও অত্যাচার না করে সেজন্যে ইসলাম ঘোষণা করেছে,
وَلاَ تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِّتَعْتَدُواْ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ
“আর তোমরা স্ত্রীদেরকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আটকে রেখো না। আর যারা এ ধরণের জঘন্যতম অন্যায় করবে তারা নিজেদের উপরই জুলুম করবে।” (সূরা বাকারা : আয়াত ২৩১)বার্ধক্যেও নারীর সম্মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম:
বার্ধক্যে নারীদের দায়িত্ব সন্তানদের উপর অর্পন করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
وَوَصَّيْنَا الإِنْسَـٰنَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً
“আর আমি মানুষদেরকে তাদের পিতা-মাতার সাথে সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি।” (সূরা আনকাবুত : আয়াত ৮)অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে,
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
“আর তুমি তাদের (তোমার পিতা-মাতার) সামনে দীনতার পক্ষপুটকে বিছিয়ে দাও। আর বলো যে, হে আমার রব! আপনি তাদের উপর রহম করুন, যেমন তারা আমার উপর বাল্যকালে রহম করেছেন। ” (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ২৪)অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
وَإِن جَـٰهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا وَصَـٰحِبْهُمَا فِى الدُّنْيَا مَعْرُوفاً
“আর তাঁরা যদি তোমাকে আমার সাথে শিরক করার এমন বিষয়ের বাধ্য করে তোমাদের কাছে যার জ্ঞান নেই, তবে (সেক্ষেত্রে) তুমি তাঁদের অনুসরণ করো না। তবে তাঁদের সাথে দুনিয়াতে সৎব্যবহার এবং সদাচারণ বজায় রাখো।” (সূরা লুকমান, আয়াত ১৫)
পোস্টটি যতজন পড়েছেন : ২৩৩