৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কী কী সর্বনাশ করলেন

বাংলাদেশ নামক আমাদের আজকের এই ভূখণ্ডের মোটামুটি তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস আছে, নামও ছিল ভিন্ন। যেমন প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে এটা ‘গঙ্গারিডই’ নামে পরিচিত ছিল (ক্রিস্টপূর্ব ৩০০ সাল)। মধ্যযুগে এ অঞ্চলকে বোঝানোর জন্য ‘বাঙ্গালা’ নামে পরিচিতি পায়। বাংলার সুলতানদের ‘বাঙ্গালার শাহ’ বলে ডাকা হতো। মুঘলদের সময় এ অঞ্চলকে সবাই ‘সুবাহ-ই-বাংলা’ বলে ডাকত। বাংলাকে প্রথম বিভক্ত করে ব্রিটিশরা ১৯০৫ সালে– ‘পূর্ব বঙ্গ’ ও পশ্চিশ বঙ্গ, যদিও আসামসহ অনেক অঞ্চল আলাদা করা হয়। পরে প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। দ্বিতীয়বার বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। পূর্ববঙ্গের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ত্রিপুরা চলে যায় ভারতের অংশে আর সিলেট যুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানের অংশে।
এই তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে আমাদের এই ভূখণ্ডে শেখ হাসিনার মতো এমন নৃশংস জালেম, চরম স্বৈরাচার এবং ক্লেপটোক্রাটিক ফ্যাসিস্ট শাসক আর কখনোই আসেনি। আর পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে এমন বীভৎস ‘মহিলা স্বৈরাচার’ আর দ্বিতীয়টা ছিল বলে আমার জানা নেই। বর্তমান দুনিয়ায় তিনি ‘লেডি হিটলার’ নামেও পরিচিতি পেয়েছেন। বাংলাদেশের যেসব সর্বনাশ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা করলেন, তার মাশুল বাংলাদেশকে অন্তত এক শ বছর ধরে দিতে হবে। এখানে শুধু ১০টা সর্বনাশের কথা তুলে ধরছি।
এক. লাখো জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শুধু নিজের স্বার্থের কারণে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে এ দেশকে ‘ভারতের কলোনি’ বানিয়ে ছেড়েছেন; অর্জন করেছেন ‘এ শতাব্দীর ঘসেটি বেগম’ খেতাব। একই সঙ্গে, নিজের দেশ, সংস্কৃতি এবং ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে তিনি ভারতের দাসত্ব ও পদলেহনের সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন।
দুই. মুক্তিযুদ্ধকে নতুন বয়ানে বানিয়ে ফেলেছেন একটা ইন্ডাস্ট্রি, পৈতৃক সম্পত্তি, টাকা কামানোর মেশিন এবং ‘জোজোন অব করাপশন’। ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে ‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদির মতো জাতীয় বিষয়গুলো ধুলায় মিশিয়ে, পচিয়ে এতটাই দুর্গন্ধযুক্ত করে ফেলেছেন, নতুন প্রজন্ম এগুলোকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। চরম বৈষম্যের কোটাব্যবস্থা, দলীয় কর্মীদের প্রায় এক লাখ ভুয়া মুক্তিযুদ্ধ সনদ প্রদান এবং বিসিএস পরীক্ষায় প্রায় দেড় দশক ধরে আবেদ আলীদের দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের লুক্রেটিভ ব্যবসা সম্প্রসারণ করে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের বিশেষ করে চাকরিবঞ্চিত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বুকে যে বঞ্চনার লেলিহান দাবালন তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তা হয়তো আর কখনো নিভে যাবে না।
তিন, তিনি বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ঘৃণাতন্ত্রের’ জননী। তার প্রবর্তিত ঘৃণার লেলিহান শিখায় জ্বলেছে সারাটা দেশ : কখনো লগি-বইঠার তাণ্ডবে; কখনো চাপাতির আঘাতে; আবার কখনো পুলিশ, র্যাব কিংবা বিজিবির নির্বিচার নৃশংস গুলিতে। এতে রেহাই পায়নি পথচারী, ছাত্রী, মা এবং শিশুরাও।
চার. তারই ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে ছড়ানো হয়েছে ভয়ংকর ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়া। মুসলমানদের বানানো হয়েছে জঙ্গি, পোড়ানো হয়েছে পবিত্র কোরআন, হত্যা করা হয়েছে শত শত আলেমকে, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে এই বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। রিমান্ডে নিয়ে টর্চার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার এবং গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের খতিয়ানগুলো হাজার বছরের ইতিহাস হয়ে থাকবে। বিশ্বের প্রথম ‘লেডি হিটলার’ হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন দুনিয়ায় ইতিহাসে।
পাঁচ. তার হিংসা ও ঘৃণাতন্ত্রের ছোবলে পুরা দেশ একসময় ছিল আস্তিক-নাস্তিক বলয়ে বিভক্ত এবং চরম ফেতনায় নিমজ্জিত, পরে বিভক্ত হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আর ‘রাজাকারের বাচ্চা’য়! চেতনার নামে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্ব তৈরি করে পুরো দেশকে নিশ্চিত সংঘাত এবং গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। দেশের পুরো রাজনীতিকে ১৯৭১ সালের লৌহ-পিঞ্জরে আবদ্ধ করে; অন্যসব দল-মত এবং পথকে ক্রিমিনালাইজ করে, গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এশিয়া মহাদেশের প্রথম লুটতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ
ছয়. দেশের মানুষের শেষ আশ্রয় বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছেন। ‘হাইকোর্টের রায় হাইকোর্ট দেয় না, আসে বঙ্গভবন থেকে’ এমনই স্বীকারোক্তি মিলেছে তারই পোষা এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি থেকে।
সাত. তার দলীয় কর্মী বিশেষ করে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগকে বানিয়েছেন এ যুগের ভয়ংকর এবং বীভৎস সন্ত্রাসী এবং ‘কিলার স্কোয়াড’। ক্যাম্পাসে টর্চার সেল গঠন করে ভিন্নমতের ছাত্র নির্যাতন, লগি-বইঠা দিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করা, হত্যা করে লাশ কেটে টুকরো টুকরো করাÑ এ ধরনের হাজারো লোমহর্ষক কাহিনি আছে এই সন্ত্রাসী বাহিনীর। শেখ হাসিনা এদের সবাইকে দিয়েছেন লিগ্যাল ইমিউনিটি। এমনকি ফাঁসির আসামি হয়েও এরা পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা, লোভনীয় চাকরি এবং প্রমোশন!
আট. তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ‘গণহত্যার জননী’। অন্তত ছয়টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তারই শাসনামলে। ২৮ অক্টোবরের লগি-বইঠার তাণ্ডব, শাপলা চত্বর, পিলখানা, সাঈদীর রায়-পরবর্তী ম্যাসাকার, সাতক্ষীরা ম্যাসাকার এবং জুলাইয়ে কোটাবিরোধী নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এবং সীমাহীন নির্যাতন হাজার বছর ধরে গণহত্যার সাক্ষী হয়ে থাকবে। তার ‘কিলার ইন্সটিংক্ট’ এতটাই জঘন্য যে, এই কিলিং মিশনে দেশীয় কিলারদের পাশাপাশি তিনি ভাড়া করে এনেছেন ‘র’-এর প্রফেশনাল কিলারদের। তার শাসনামলের শেষ পাঁচ বছরেই হত্যার শিকার হয়েছে ১৬ হাজার মানুষ (প্রতিদিন গড়ে ৯ জন)!
নয়. একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে তিনি দেশের প্রায় প্রতিটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনেছেন। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধ্বংস, দুর্বল, বিতর্কিত এবং দলীয়করণে তিনি ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবেন। সংস্কারের নামে শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনকে পকেটে পুরেছেন আর জাতীয় সংসদকে বানিয়েছেন গানের আসর আর শেখ পরিবারের তৈলমর্দনের কারখানা।
দশ. রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, বিদেশে অর্থ পাচারসহ সীমাহীন দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার যে রেকর্ড শেখ হাসিনার আমলে হয়েছে, তার ধারে-কাছে দুনিয়ার অন্য কেউ আসতে পারবে কি না সন্দেহ! দুর্নীতি আর লুটতন্ত্র এতটাই গভীর ছিল যে, শেখ হাসিনার চতুর্থ শ্রেণির পিয়ন পর্যন্ত কামিয়ে ফেলেছিলেন ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ! বেনজির, আজিজ, মতিয়ার, কথিত দরবেশ এবং এস আলমসহ শত শত মহালুটেরা তৈরি করে একদিকে কায়েম করেছেন মাস্তানতন্ত্র এবং মগের মুল্লুক, অন্যদিকে পুরো দেশটাকে পরিণত করেছেন শ্মশানে।
সম্প্রতি অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অনেক ভয়াবহ তথ্য। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিদেশে পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন (২৩ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার। বর্তমান বাজার হারে (প্রতি ডলার ১২০ টাকা), এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়াড়, আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এই টাকা দিয়ে ১৬৩৫টা মেট্রোরেল, ৯৮৮টা স্যাটেলাইট আর ৯০টা পদ্মা সেতু বানানো যেত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা শেখ হাসিনা তার প্রথম পাঁচ বছরের শাসনামলে পুরোটাই পরিশোধ করে ঋণের পরিমাণ শূন্যতে আনতে পারতেন, কিন্তু সেই ঋণ এখন ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে! কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিদিনের সাংবাদিক কিংশুক প্রামাণিক (৭ আগস্ট, ২০২৪) বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশকে শেষ করলেন, দেশের মানুষকে ঋণে জর্জরিত করলেন… দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন, অর্থনীতিকে পঙ্গু করে একা দেশ থেকে বিশাল কার্গো বিমানে ১২৫টি লাগেজ ভরে সোনা, ডলারসহ মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে নিরাপদে ভারতে পালিয়ে গেলেন।’
জুলাই বিপ্লব যে কতটা জরুরি ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। দুনিয়ায় ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান ছিল চীনের তিয়েনামিন স্কয়ারে (১৫ এপ্রিল থেকে ৪ জুন, ১৯৮৯)। তবে কয়েক হাজার ছাত্র গণহত্যার শিকার হলেও এই অভ্যুত্থান সফল হয়নি। বাংলাদেশে আমাদের নবীন শিক্ষার্থীরা যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে দেশটাকে জালেমমুক্ত করলেন, সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত সফল গণঅভ্যুত্থান’। তারা উৎখাত করল বাংলার গত তিন হাজার বছরের সবচেয়ে বড় ডেসপট বা স্বৈরশাসককে। ৫ আগস্ট ২০২৪ পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিস্ময়কর ঘটনা। আজ থেকে শত শত বছর পরও বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী এই বিস্ময়কর ইতিহাস পড়বে, স্যালুট জানাবে আমাদের এই নবীন শিক্ষার্থীদের, যারা বুলেটের সামনে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে, সব বাধা মাড়িয়ে উপহার দিয়েছে স্বস্তি আর স্বাধীনতার এক অনবদ্য স্বাদ। যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা নিতে থাকবে পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষ। তারুণ্যের এই বিস্ময়কর ইতিহাস বুকে ধারণ করেই আমাদের গড়তে হবে নতুন বাংলাদেশ, যা একদিকে হবে বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ আর সুবিচার এবং ইনসাফে পূর্ণ; অন্যদিকে হবে সব ধরনের জুলুম এবং অন্যের বশ্যতা থেকে মুক্ত।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ