মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরী
শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। একটি দেশের জাতীয় জীবনের উন্নতির বা অগ্রগতির মূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। তাই জাতীয় জীবনে উন্নতির জন্য শিক্ষার বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। ফলে এর জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের উন্নত জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন সব ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে জনগণের জন্য সার্বজনীন, গণমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গীকার করা হয়েছে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার বিষয়টিকে আইনগতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই শিক্ষকদের সকল বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা সরকারের দায়িত্ব। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মূল দায়িত্ব সরকারের এবং বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত।
এদেশের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় বরাদ্দ আর বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ব্যয় বরাদ্দে পাহাড়সম পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেলায় আলাদা!
সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ীভাড়া মূল বেতনের ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। অথচ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা) শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ী ভঅড়া চাকরী জীবনের শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত মাত্র ১০০ টাকাই! অপরদিকে, চিকিৎসা খরচ সরকারী শিক্ষকরা পান ৭৫০ টাকা; বেসরকারী শিক্ষকরা পাচ্ছেন মাত্র ১৫০ টাকা। এমন অনিয়ম কিংবা আজব নিয়ম পৃথিবীর কোন দেশে প্রচলিত রয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই!
অথচ একই সিলেবাস, একই পাঠ্যপুস্তক, একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং একই নিয়মে কানুনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে পিতা মাতার চেয়ে শিক্ষকদের অবদান কম নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। আর শিক্ষক সমাজ বা শিক্ষকরা জাতির প্রধান চালিকা শক্তি। এক কথায বলা যায় শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তথা দেশ-জাতি তার দ্বারা উপকৃত হয়। এজন্য শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখানো আবশ্যক। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব শিক্ষকরা বলছেন, যা বেতন দেয়া হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। এখন চাকরী জাতীয়করণ হলেই তাঁরা মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন। সত্য বলতে কি, সারা দেশের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
বেসরকারী শিক্ষকদের লাঞ্চনা-বঞ্চনা, মানবেতর জীবন যাপন ও দুর্গতি দেখে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে সাহস করছে না। শিক্ষকতা চাকরীতে নেই পদোন্নতি, নেই ইনক্রিমেন্ট, নেই পূর্ণ উৎসব বাতা, নেই পেনশন! যার ১০০ টাকা বাড়ী ভাড়া কিংবা ১৫০ টাকা চিকিৎসা খরচ দিয়ে এ অসহায় শিক্ষকদের বলা হয় ‘জাতি গঠনের কারিগর।’
বেসরকারী শিক্ষকরা বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছেন। তাঁরা তো আর মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার জন্য কিংবা কোটিপতি, শিল্পপতি, পুঁজিপতি বা প্রভাবশালী-প্রতাপশালী লোক হওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন না। তাঁরা তো ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোন নেয়ার জন্য আন্দোলন করছেন না। তাঁরা তো মাত্র দু’ মুঠো অন্নের জন্যই আন্দোলন করছেন, যা তাঁদের ন্যায্য পাওনা, তাও আবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে। জ্বালাও-পোড়াও, বা বিশৃৃঙ্খলপূর্ণ আন্দোলন তাঁরা পছন্দ করেন না কিন্তু। তুলনামূলকভাবে তাঁরা ভদ্র, নম্র, শান্তশিষ্ট ও ধৈর্য্যশীল। যেহেতু শিক্ষক সমাজ জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁরা আন্দোলন করার লোক নন। বাঁচার দায় ভীষণ দায় । তাঁদের পেটে ভাত নেই। তাই তাঁরা ভাতের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে আন্দোলনের নেমেছেন। কাজেই তাঁদের এই আন্দোলন আযৌক্তিক নয়, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্য আজও বদলায়নি। শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে গুরুত্ব কম আরোপ করা হচ্ছে না। অথচ বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে যথার্থ অর্থে ভাবা হচ্ছে না! বেসরকারী শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে সরকারী বা জাতীয় পর্যায়ে যতটুকু অপরিহার্য ছিল, তা দেয়া হয়নি। তারপরও আমরা শিক্ষার উন্নয়নের কথা দিব্যি বলে যাচ্ছি। শিক্ষার উন্নতি, শিক্ষার্থীর উন্নয়ন, জাতীয় উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়ন চাইলে সর্বাগ্রে ঘটাতে হবে শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়ন। যেহেতু, শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষাও বাঁচবে। শিক্ষকরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি।