মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরী
শিক্ষকতা কার্য বড় আজব ধরনের! এটা সহজ কাজও নয়, আবার বিরক্তিকর একঘেঁয়ে বিষয়ও নয়। এ কাজে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। শিল্পী বা কারিগর জড় বস্তু নিয়ে কাজ করেন; কিন্তু শিক্ষককে করতে হয় সজীব বস্তু নিয়ে যে বস্তুর ‘মন’ বলে একটা পদার্থ আছে, যা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হতে পারে।
তবে কোন কোন ব্যাপারে শিক্ষকতা কার্যকে সহজ বলে মনে হয়; আর এই সহজ দিক হল-শিক্ষকের অবসরপূর্ণ কর্মসূচী এবং চিত্ত বিনোদনার্থে অবসর যাপনের সুযোগ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বছরের এক-তৃতীয়াংশ হতে দুই-পঞ্চমাংশ সময় বন্ধ থাকে। এই সময়ে শিক্ষক তাঁর ক্লান্ত মনকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার নিমিত্তে মনের মত স্থানে বেড়িয়ে আসতে পারেন।
শিক্ষকের এই অবসরপূর্ণ জীবনে তাঁকে অবশ্য শিক্ষকতা সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু কাজ সমাধা করতে হয়। এসবের কিছু কিছু কাজ ছকবাঁধা; যথা-পরীক্ষার খাতা দেখা এবং কিছু কিছু কাজ ঐচ্ছিক, যথা শিক্ষাদান প্রস্তুতি, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ, গবেষণা ইত্যাদি।
একজন শিক্ষকের পক্ষে বড় সুবিধা হলো এই যে, তাঁকে অফিস কর্মচারীর ন্যায় দিনের একটি বাঁধা-ধরা, নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট আসনে বসে সময় কাটাতে হয় না।
প্রতিনিয়ত কোন না কোন মূল্যবান চিন্তা-চেতনায় মগ্ন থাকা শিক্ষকতা জীবনের চরম সার্থকতা। মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত শিক্ষককে অবসর সময়েও শিক্ষার্থীদের মঙ্গল কামনা, জ্ঞান-চর্চা ইত্যাদিতে সময় অতিবাহিত করতে হয়। কারণ, ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক কল্যাণমূলক কাজ করা ছাড়া তাঁর আর কোন কামনা-সাধনা নেই।
সৃষ্টির আনন্দই হচ্ছে শিক্ষকতা জীবনের পরম আনন্দ। শিশুরা তাঁর (শিক্ষক) নিকট আসে অপরিণত মন নিয়ে। এই মনকে পূর্ণ পরিণতির পথে বিকশিত করা এবং তাদের (শিশু) চরিত্রকে সুগঠিত করে সুনাগরিক ও যোগ্যতমরূপে গড়ে তোলা শিক্ষকের কাজ। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভাল চরিত্র গঠন, শিক্ষকের ওপরেই অনেকখানি নির্ভর করে এই ভাল চরিত্র গঠনের কাজ। শিক্ষক হিসেবে তাঁর কাজ হচ্ছে, শিক্ষার্থীর মন মেজাজ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের অপরিণত মনকে সুবিন্যস্ত করে পরিপক্বতা লাভে সহায়তা করা এবং এইভাবে দেশ ও সমাজের ভবিষ্যৎ সুনাগরিককে গড়ে তোলা।
শিক্ষকতা জীবনের সবচাইতে বড় অসুবিধা হলো তাঁর দারিদ্র্যতা। পেশা হিসেবে শিক্ষকের বেতন সত্যিই কম। অথচ তাঁর সমমানের ব্যক্তিগণ অন্যান্য পেশা গ্রহণ করে ২/৩ গুণ বেশি বেতন পেয়ে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষে আনাড়ি মজুরেরাও (তাঁর) শিক্ষক চাইতে অধিক বেতন পেয়ে থাকে! বেতনের এই স্বল্পতার জন্য তাঁর পারিবারিক জীবনযাত্রারমান সমপর্যায়ের অন্যান্যদের তুলনায় বেশ নিচুতে থেকে যায়। ফলে সমাজের চোখে তাঁর মর্যাদা কিছুটা হেয় প্রতিপন্ন হয়! আর যারা তাঁর কদর বুঝেন, তাদের নিকট তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত হন। এইভাবে শিক্ষকের দারিদ্র্য জীবন বরণজনিত ক্ষতির আংশিক পূরণ হয়ে যায়? অল্প বেতন পেয়ে দারিদ্র-পীড়িত জীবনযাপন করলেও শিক্ষকতা পেশায় যথেষ্ট সম্মান, চাকরীতে বেশ নিরাপত্তা আছে। কারণ, সমাজের ছেলেমেয়েদের সব সময়ই শিক্ষা লাভের প্রয়োজন রয়েছে এবং তাদের শিক্ষা লাভের জন্য সকল অবস্থায় স্কুলও থাকবে, আর পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন হবে প্রতিনিয়ত। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের দিনে অফিস আদালতে বা কোম্পানীতে লোক ছাঁটাই করা হয় এবং মিল ফ্যাক্টরীর শ্রমিকদের মধ্যে বেকার সমস্যা প্রকটরূপে দেখা দিয়ে থাকে, কিন্তু এই দুর্দিনের উপযুক্ত লোকের জন্য শিক্ষকতা চাকরীর অভাব ঘটে না। শিক্ষকতা জীবনে সবচাইতে বড় তৃপ্তিÑতিনি বৃদ্ধ বয়সেও তরুণ মন নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তরুণ মনের সংস্পর্শে থাকার সুযোগ তা শিক্ষকতা ছাড়া অন্য পেশায় সম্ভবপর নয়।