১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন ইসরায়েলের, কী আছে এই চুক্তিতে

ইসরায়েল সরকার হামাসের সঙ্গে গাজা যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর ফলে রোববার থেকেই এটি কার্যকরের পথ তৈরি হলো। খবর বিবিসির।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক ঘণ্টার আলোচনার পর চুক্তিটি অনুমোদন করা হলেও দুজন কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রী এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।

এর আগে দেশটির যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা চুক্তিটি অনুমোদনের সুপারিশ করে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে যে ‘এটি যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনকে সমর্থন করে’।

 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং হামাস উভয়েই চুক্তির বিস্তারিত চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর এই ঘোষণা এলো। এর দুদিন আগে মধ্যস্থতাকারী কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছিল।

 

চুক্তি অনুযায়ী হামাসের হাতে থাকা ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিবে। চুক্তির প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই বন্দি বিনিময় হবে।

 

একই সঙ্গে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘরে ফেরার অনুমতি পাবে। পাশাপাশি ত্রাণবাহী লরিগুলোকে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

দ্বিতীয় ধাপে হামাসের হাতে থাকা বাকি জিম্মিরা মুক্তি পাবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হবে। এর মাধ্যমে ‘টেকসই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে’।

আর তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে গাজা পুনর্গঠন হবে- যা শেষ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। একই সঙ্গে মৃত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে।

কাতার জানিয়েছে, প্রথম ধাপে যেসব জিম্মি মুক্তি পাবেন তার মধ্যে থাকবেন ‘বেসামরিক নারী, নারী সেনা, শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ ও আহত বেসামরিক নাগরিকরা’।

ইসরায়েল বলছে, যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনে তারা তিন জন জিম্মির মুক্তি আশা করছে। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে ছয় সপ্তাহ ধরে ছোট ছোট দলে জিম্মিরা মুক্তি পাবে।

 

ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ১২শ ব্যক্তিকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করার জবাবে হামাসকে ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল দেশটি। সংগঠনটিকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আরও কিছু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৮৭০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। আরও প্রায় ২৩ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছে। সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য, জ্বালানি, ঔষধ ও আশ্রয়ের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

ইসরায়েল বলছে, হামাসের হাতে এখনো ৯৪ জন জিম্মি আছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে যুদ্ধের আগে চারজন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে দুজন মৃত।

চুক্তির বিষয়ে ইসরায়েলি সরকারে ভোটের আগে সংস্কৃতি মন্ত্রী মিকি জোহার বলেন, এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমরা সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ আমাদের কাছে সব শিশু ও নারী ও পুরুষকে ঘরে ফিরিয়ে আনাটা গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেছেন, আমরা আশা করি ভবিষ্যতে গাজায় আমাদের কাজ শেষ করতে আমরা সক্ষম হবো।

তবে ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-জিভির বলেছেন চুক্তির বিস্তারিত থেকে তিনি আতঙ্কিত কারণ এতে জিম্মিদের বিনিময়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য মন্ত্রীদের আহবান জানিয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে চুক্তিটি অনুমোদিত হলে তার দল সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে। তবে তিনি বলেছেন যে পার্লামেন্টে সরকারের পতন ঘটাবেন না এবং ‘হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আবারো পূর্ণ মাত্রায় শুরু হলে’ তিনি সরকারে ফিরে আসবেন।

অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচ বলেছেন যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের পরেই আবার যুদ্ধ শুরু না হলে তার দল রিলিজিয়াস জায়ানিজম পার্টিও সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে।

তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি কিছু জিম্মি পরিবারেও বিভক্তি ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। তাদের ভয় হলো প্রথম ধাপের পর তাদের স্বজনদের গাজায় পরিত্যাগ করা হতে পারে। তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

৪৬৯ দিন ধরে আমাদের স্বজনেরা জিম্মি অবস্থায় আছে এবং এখন শেষ পর্যন্ত একটি আশা তৈরি হলো, বলছিলেন এইনাভ যানগৌকার। তার ২৫ বছর বয়সী ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছিল।

তিনি বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করতে ও সবাইকে ফিরিয়ে আনতে এই চুক্তি শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করা উচিত। যুদ্ধ শেষ করা, সবাইকে ফেরানো এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই ইসরায়েলের স্বার্থ।

বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সরকারের মধ্যে ভোটের আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু বৈঠকটি বিলম্বিত হয় হামাসের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু চুক্তির একটি অংশ পরিত্যাগের অভিযোগ করলে। হামাস ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘোষণা করা হয় যে দোহা মধ্যস্থতাকারী দল চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। হামাসও এক বিবৃতিতে জানায় যে চুক্তির বাধা দূর হয়েছে।

হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এএফপিকে জানায় যে প্রথম তিনজন নারী জিম্মি মুক্তি পাবেন। শুক্রবারই ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয় ৯৫ ফিলিস্তিনি বন্দির তালিকা প্রকাশ করে। জিম্মিদের বিনিময়ে তারা মুক্তি পাবেন। এর মধ্যে ৬৯ জন নারী, ১৬ পুরুষ ও দশটি শিশু আছে বলে এএফপি জানিয়েছে।

শুক্রবার কায়রোতে চুক্তি বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে বৈঠক হয়েছে বলে মিশরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে মিশর, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জয়েন্ট অপারেশন রুম গঠনের বিষয়টিও আছে।

মিশরের রাষ্ট্রায়ত্ত আল-কাহেরা নিউজ টিভি জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির সময় প্রতিদিন ৬০০ ত্রাণবাহী লরি গাজায় প্রবেশ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাজা প্রতিনিধি জানিয়েছে এটি আরও বাড়তে পারে যদি মিশরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিংসহ অন্য ক্রসিংগুলো খুলে দেওয়া হয়।

সংস্থাটি আগে থেকে তৈরি কিছু হাসপাতালও গাজায় সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে। গাজায় অর্ধের বেশি হাসপাতাল অকার্যকর হয়ে গেছে। আর বাকীগুলো আংশিক কার্যকর আছে। যুদ্ধবিরতির বিষয়ে গাজায় বুধবার রাত পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, আগের দিন পর্যন্ত তারা গাজায় ৫০টির মতো সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ