১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মেসির ছোঁয়ায় মার্কিন ‘সকার’ রূপ নিচ্ছে ফুটবলে

‘খেলা শেষ হল, শেষ হয় নাই বেলা।’ আর্জেন্টাইন বিশ্বকাপজয়ী তারকা লিওনেল মেসিও যেন কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়ে উঠেছিলেন এই অমর বাণী। ২০১৬ সালে খেলা শেষ করার ঘোষণা দিয়েও ফিরে এলেন। ২০২২ সালে জিতলেন বিশ্বকাপ, যেন জানান দিলেন ‘শেষ হয় নাই বেলা’। এবার সেই মেসিই মার্কিন মুলুকের ‘সকার’কে ফুটবলে রূপ দেয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন কাঁধে।

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বেড়ে ওঠা ফুটবল ‘সকার’ নামেও পরিচিত ছিল। বলা চলে, শুরুতে এর নাম সকারই ছিল। বর্তমানে সারাবিশ্বে ফুটবল নামটি জনপ্রিয়তা পেলেও সকার সেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে ভক্তরা ফুটবল নামটিই জানেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশসহ বেশকিছু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ফুটবলকে সকার নামে ডাকা হয়। শুধু তাই নয়, সেখানে ফুটবল বলতে ভিন্ন খেলাকে বোঝানো হয়। যেমন- আমেরিকায় বলা হয় ‘আমেরিকান ফুটবল’, এটি আমাদের পরিচিত ফুটবল খেলা থেকে আলাদা।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্যে সকারের পরিবর্তে ফুটবল নামটির ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি ইউরোপীয় গণমাধ্যম ছাড়া কোথাও সকারের প্রচলন সেভাবে থাকে না। অবশ্য এই ফুটবল নামের পেছনেও রয়েছে অনেক বড় ইতিহাস। শুরুতে এই নামটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হতো। স্প্যানিশে ‘ফুতবোল’, পর্তুগিজে ‘ফুতিবোল’, ব্রাজিলে ‘ফুচিবো’সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নাম নিয়ে বেড়ে ওঠে ফুটবল। তবে এক সময় সব জায়গায় ফুটবলের জয়জয়কার হয়।

ব্যতিক্রম থাকে আমেরিকায়। গত জুন মাস শেষে ফরাসি ক্লাব পিএসজি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে নাম লেখান মেসি। এরপরেই নতুন করে আলোচনায় আসে মার্কিন সকার। দেশটিতে ফুটবলকে সকার নামে ডাকা হলেও খেলাটির তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। বেসবল, বাস্কেটবল কিংবা আমেরিকান ফুটবলের ভীড়ে মেসি-রোনালদোদের ফুটবল মার্কিন মুলুকে সাড়া ফেলেনি। তবে সেই জায়গায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেন লিওনেল মেসি।

সামাজিক মাধ্যমে বিপ্লব

এখন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় দেখার পথ সহজ করেছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। যেখানে প্রভাবকের ভূমিকায় থাকেন বিভিন্ন খেলোয়াড়, অভিনেতা কিংবা জনপ্রিয় ব্যক্তিরা। এই তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছেন মেসি। আর্জেন্টিনার এই ফুটবলার ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের পর থেকে ‘সোনার হরিণ’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছেন। অবশ্য তার আগেও সামাজিক মাধ্যমের একটি বড় অংশ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর সেই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পিএসজি ছেড়ে মায়ামিতে যাওয়ার সময়ে।

মেসির ক্লাব ত্যাগের ঘোষণার পরে দেখতে দেখতে ইনস্টাগ্রামে পিএসজির অনুসারী কমে যায় কয়েক মিলিয়ন। অপরদিকে ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেয়ার খবরের পর থেকে হু হু করে বাড়তে থাকে ক্লাবটির অনুসারীর সংখ্যা। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় মায়ামির ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৩৭ লাখ অনুসারী যোগ হয়। আর সকলেরই আগ্রহ তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের সকার নিয়ে। এমন ঘটনা দেখে দেশটির জনগণের মধ্যেও নতুন করে আগ্রহ জন্ম নেয়।

মায়ামির কল্যাণে টুর্নামেন্টে জোয়ার

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল ফেডারেশন মেজর লিগ সকার (এমএলএস) নামে টুর্নামেন্ট শুরু করে। আর এই টুর্নামেন্টে ২০১৮ সালে যুক্ত হয় ইন্টার মায়ামি। যেখানে চলতি বছরে যোগ দিয়েছেন মেসি। এছাড়াও রয়েছেন তার সাবেক ক্লাব সতীর্থ সার্জিও বুসকেটস। এই দুই ফুটবলারকে দলে ভিড়িয়ে যেন নতুন মাত্রা যোগ করেছে মায়ামি। যেই এমএলএসকে কেউ চিনতো না, সেই টুর্নামেন্ট নিয়ে ভক্তরা ইতোমধ্যে হিসেব কষাও শুরু করে দিয়েছেন। তাতে বলা যায়, মায়ামির কল্যাণে টুর্নামেন্টে জোয়ার এসেছে। আর এখানে মূল প্রভাবকের ভূমিকায় রয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা।

টিকিট মূল্য

সকারের প্রতি আমেরিকানদের তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মেসির কারণে সেই আগ্রহ ফিরে এসেছে। যেন তারা সকার নয়, সারাবিশ্বে পরিচিত ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত হলেন মেসির মাধ্যমে। ফুটবলের খুদে এই জাদুকরের ছোঁয়ায় তাদের আগ্রহ এতটাই বেড়ে গেল যে, মেসির অভিষেক ম্যাচের টিকিটের দাম বেড়ে হলো পাঁচ গুণ। আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই টিকিটও ফুরিয়ে গেল। খেলা দেখতে আসা অনেকেই জানিয়েছেন, এটি তাদের জীবনের প্রথম সকার ম্যাচ, যা তারা স্টেডিয়ামে দেখতে এসেছেন। সেটি কেবল মেসির কারণে।

আকাশছোঁয়া দামেও মেসির অভিষেক ম্যাচের টিকিট পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল প্রেমীরা। টিকিট বিক্রয় সংস্থা ভিভিড টিকিটস জানিয়েছিল, ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে মেসির অভিষেক ম্যাচের টিকিটের দাম ধরা হয়েছিল এক লক্ষ দশ হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবুও পিছু হটেননি ভক্তরা। এরপরের ম্যাচেও তাদের একই আগ্রহ দেখা গেছে। যার কারণে পূর্বের টিকিট মূল্য থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকায় বর্তমানে মায়ামির ম্যাচের টিকিট বিক্রি হচ্ছে।

বিশ্ব মিডিয়ার আগ্রহ

এ দিকে কেবল ভক্তদেরই নজর ফেরেনি এমএলএসে, বিশ্ব মিডিয়া এখন টুর্নামেন্টের দিকে তাকিয়ে। মেসি কখন কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, অনুশীলন কখন কিংবা মায়ামির ম্যাচ কখন ইত্যাদি তথ্য বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে। এছাড়া অ্যাপল ২.৫ বিলিয়ন ডলারে ১০ বছরের জন্য টেলিভিশন সম্প্রচার চুক্তি করেছে। এই চুক্তির ফলে এমএলএসে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন বিশ্ব মিডিয়ার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও চাইছে টুর্নামেন্টটির সঙ্গে যুক্ত হতে।

বৈশ্বিক আসরের প্রস্তুতি

২০২৪ সালে কোপা আমেরিকার আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র। পরের বছর ক্লাব বিশ্বকাপও একই দেশে গড়াবে। আর ২০২৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপে মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে যৌথ আয়োজক হিসেবে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এতগুলো বৈশ্বিক আসরের জন্য দেশটি ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করবে, এটিই স্বাভাবিক। আর সেই কাজটিই যেন সহজ করে দিচ্ছেন লিওনেল মেসি। ফুটবল বিশ্বে দেশটিকে এবং সেখানকার ফুটবলকে তুলে ধরার বিষয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাত্র ২ ম্যাচেই যে সাড়া তিনি ফেলেছেন তাতে অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সকার’ যে ‘ফুটবল’ হয়ে উঠবে, এটি বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ