মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ:
জন্ম ১ আগস্ট ১৯৬৭ সাল। বাবা মৌলানা মুহাম্মাদ হুসাইন এবং মা মুহসেনা বেগম। হোয়ানক, মহেশখালি, কক্সবাজার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলাবিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি নব্বই দশকে লেখালেখির সূচনা; মূলত কবি―গল্প প্রবন্ধের পাশাপাশি শিশু সাহিত্যে অনুরক্ত। গবেষণার বিষয়―নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে বাঙালির জীবন। ‘পোড়ামাটির সানাই’(২০১৬)―তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। অন্ধকারের সুর ও স্বপ্নময়তার মায়াবী ব্যঞ্জনা এই গ্রন্থের প্রাণ―এখানে জোছনা-আঁধার, বাউলবিষাদ ও অনিকেতচেতনা স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে মুদ্রিত। এ বইয়ের কয়েকটি কবিতায় কবির ব্যক্তিগত বোধ ও বুদ্ধিবৃত্তির ছায়াচিত্র রূপায়িত। কায়া, ছায়া ও মায়ার র্তীযক প্রণয়ে কবিতাগুলো গীতল-বিদগ্ধ-বিদীর্ণ।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবী রোদের ডানা’ (২০১৪) একটি আলাদা স্বর ও সুরে কবিকে চিহ্নিত করে; কবিতাগুলোর যাদুময় ঘোর ও ধ্বনিতরঙ্গের সুরেলা আমেজ তাকে শনাক্তযোগ্য মাত্রা প্রদান করে। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র বয়ান ভঙ্গির কারণে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ও সমাদৃত।
অপরাহ্ণের নীল চোখ (২০১৫) তার গল্পগ্রন্থ এবং চড়ুইভাতির লাল টিপ (২০১৪) ও শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ। তিনি জাতীয়, আঞ্চলিক দৈনিকসহ বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা ও ছোটোকাগজে নিয়মিত লিখেন; বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত।
যমজআঁধার
তোমার কোমল হাত ছুঁয়ে গেছে ভোরের বাতাস, দুপুরের রোদ —– সন্তর্পণে একা,
তোমার অলকদাম ছড়িয়েছে বৈধব্য বিষাদ গান, বেহালা বিজনসুর;
বিপন্নবৈষ্ণব এক গেরুয়া আঁচল তার খুঁজে ফিরে মৃত্তিকার মুখ —– সায়াহ্নে নদীর তীর
দূর অরণ্যের বাঁয়ে দুই চোখ তার।
কী মধুর সুরে যাদুর ছোঁয়ায় এঁকে গেছো তুমি দিন ও রাতের মুখ, কেউ কি দেখেছে এই
রুপোর চাঁদোয়া —— বনপোড়া হরিণীর আদিমঅভিসার!
আমিও মানুষ —– ইচ্ছের ফানুসে উড়ে আর পুড়ে আঁধারের সবটুকু গিলে গিলে খাই; রেখে
যাই জোছনার শিস আর সুর —- ভুলে যাই যতো পথ —–পিদিমপ্রহর।
রাতের বেদনা ভুলে নীরবে দাঁড়িয়ে ভাবো রোদপোড়া কাকতাড়ুয়া একা; ঈষাণে
মেঘের নদী, তোমার ডানায় জমে ঘোর আষাঢ়ের যমজআঁধার।
ফেরারি
আপনারা কেউ কবিতাকে দেখেছেন?
নীল শাড়ি, খোলাচুল, লাল টিপ, সমস্ত শরীরে তার কাঠগোলাপের ঘ্রাণ —- সাত
সাগরের নুন চোখেমুখে মেখে আজ সে ফেরারি।
কেউ কি আবার বেআব্রু করেছে তাকে―খোলা চুলে ছুঁড়ে দিয়ে থুতুর নরক? নীল
শাড়ি লাল টিপ দেখে; ঘরোয়া ফুলের গন্ধ শুঁকে কেউ কি টেনেছে খুব কাছে? ওর
প্রতীক্ষায় থাকে―নিযুত নক্ষত্র নীল মেঘের মুকুট
—- অন্ধকার ছায়াপথে কৃষ্ণপক্ষরাতে।
যদিও পোশাক বদলায়, শাড়ির বদলে পরে পাঞ্জাবি কামিজ, কখনো কামিজ খুলে
টিশার্ট বা জিন্স; আলবত সে তো আমার দয়িতা — জীবনজমিনজল;
আমাদের সংসারে দুই ছেলেমেয়ে — আনন্দ ও আলো;
আনন্দ সর্বদা ডান পাশে থাকে আলো বাম পাশে।
আমি ওর আপাদমস্তক চিনি — ত্বকের তারকা কফিকালোতিল পাকা পুতিজাম —-
কোথায় কখন জেগে ওঠে ওরা সবটুকু জানি; শত সঙ্গমের ভ্রূণ জরায়ু জঠরে রেখে
আজ সে ফেরারি।
মরমিদুপুর
প্রয়াত কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে
গলুইয়ে নিত্য বসে দাঁড় টেনে যাই — করুণকিসতি দোলে কথায় তারায়;
পুরনো নীলাভ সুতোয় বুনেছি সেতারশোলক
আবিরের রঙে লাল হৃদয়মাজার।
বোশেখ ফুরোল রোদে আষাঢ়ের সুরে নাচে মেঘলামৃণাল,
নরম মাটির প্রাণে মুরুলিপ্রদীপ হাতে খুঁজেছি আমরা ওই অভেদসাকিন —
লোহুর মোহনমায়া লাগিল রজনী শেষে
ওই বুঝি ভোর হয় আঁধারআরশি ভাঙে
সহসা বাতাসে বাজে আখেরিনূপুর।
তোমার কথারা ফোটে — উজালা মোতির মালা;
— ওই সব ছবি হাসে ফাগুনপাতায়,
এ কোন কমলনামা টানিয়া মায়ার জাল কলবের কোলে হাসে মরমিদুপুর!
সবুজ সারেং
সায়াহ্নে উঠোনে ভাসে ফেরারি মেঘের ছায়া — বাউলবনের ঘ্রাণে সহসা ডাহুক ডাকে;
আমার শিথানে চরে সারস কালিম ঘুঘু বনগুইসাপ;তোমার প্রণয় যাচে চাঁদ সোনাদিয়া
দূরগামী ঢেউ।
দুহাতের দশটি আঙুল রেখেছি নদীর গায়ে — হৃদয়ে মেখেছি নুন পান চুনের পরশ,
রোদের সোহাগে গলে এ কোন সোয়ারি-নাইয়রি-নাকফুল!
রোদকে বলেছি শোনো — এবার মাটির বুকে ভালোবাসা দাও, সাগরের
সব জল ভালোবেসে ওকে রাতদিন ছোটে ঠিক তীরের মায়ায়, নদী ও
রোদের সাথে মিতালি পেতেছি — এবার ফাগুনে বুঝি নাচবে দোয়েল।
হৃদয়ের দুই তীরে আকাশ ও আখা মায়াবী রোদের বাড়ি খুঁজে ফিরে ওড়ে,
জলের বাহানা বুঝে মেঘের মিছিল গোনে জাল ও পালের প্রাণ সবুজ সারেং।
চশমা
চশমাটি খুঁজি — যাতে পড়া যায় জোছনা ও চাঁদ, জননীর মুখ, তোমার কাজল টিপ।
কতো দিন মা-কেও দেখিনি — দুই চোখ মরে গেছে এই অদেখায় ঘাসফুল মরে যায়
দেয়ালচাপায় আঁধারের ঘায়; সকালে বেরিয়ে যাই — দুপুর বিকেল যায়। দুই চোখে সব
ভাসে —গাড়ি, বাড়ি, লাল শাড়ি, রোদের চশমা, ভিখিরির মুখ।
পথ চাই — পাথেয় কোথায়!
ডাহুক কোথায়, বাউল কোথায়, কোথায় আমার মায়া — দুপুরের ডুগডুগি?
রোজ রোজ চশমা বদল করি, হাওয়াও বদলাই, দাওয়াই বদলাই — তোমাকে দেখি
না। দুই চোখ মরে গেছে এই অদেখায়। ঘরণী ও ঘর ভুলে বার বার গোলাপের কাছে যাই।
কোলাহল নয়—কবিতাকে খুঁজি।
মুখরমুখোশ নয় — জিয়লজোনাক খুঁজি — তোমাকেই খুঁজি; টিয়ে আর পেয়ারা রঙের
চশমাটি খুঁজি।
এই মায়াপথে
মায়াবতী নদী আঁধার ভেলায় আমাকে করেছে পার
— এই মায়াপথ ক্ষরণের খেয়া অথই পাথার!
কায়াবতী নদী তিরতিরে বহে
কমল চেনে না কেউ
ভাঙে ঘরদোর — মোহনার বাঁকে ফোটে ফেনাফেনা ঢেউ,
জিসমজমিনে রঙিনশহর:
নদীরা উর্বশী অমর অজর!
মায়ার শহরে যাদুর মিনারে রঙিন আঁধার;
মায়াবিনী নদী জলের দাঁড়াশ আমাকে কেটেছে —
জ্বলছে শোণিত হাড়।
কলাবতী নদী নেয়েকে করেছে পর —
গোধূলির তীরে ভাঙে সে জলের ঘর।
চিমনির মুখ
রাতচরা জোনি পোকা জ্বলে আঁধারের পদতলে, আঙুলে থুতনি চেপে হাত মুঠো করে
নাকমুখ চেপে ধরে আনমনা আসমান; —
রবি ও রুমির মুখোমুখি বসে নেরুদা ও মারকেজের কথা ভাবি — তারপর রাত ভর
মোনাজাত, কাসিদা-কিরাত; শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা। আমি ঘেমে যাই — নেয়ে নেয়ে
অবসন্ন হয়ে ওঠি, মাথার ওপর বাড়ে সিলিং ফ্যানের গতি — র্যাঁবোর ওপর মুখ গুঁজে
বেখেয়ালে তন্দ্রাঘোরে ঢলে পড়ি।
লায়লার তরজমা আর তাহকিক ভুলে যাই; কোথায় সে? মোরগের লালঝুটি ঠিকই
সূর্যের মতো জ্বলে — শবনম নামে; অন্ধ এক ভোর আজানের বেশ আগেভাগে আমাকে
আঁধারে তাড়া করেছিল।
কার্তিক এসেছে ওই ধান বনে, মনে মনে দরজায় জানালায় অলিন্দে উঠোনে — শুকনো
পাতারা ওড়ে, নিভে যেতে চায় দ্রুত তিনটা বিশের মেঘ, কোহালিয়া চর।
দক্ষিণে বাড়তে থাকে আঁধারে পাতানো ছায়া; চিমনির মুখগুলো কখনো নেভে না।
মুখগুলো মৃত
ঘোর অন্ধকারে মৃত মানুষগুলো জেগে আছে —
সকালে দুপুরে রাতে মৃত মুখগুলো হেঁটে যায়, কখনো গাড়িতে চড়ে, ওড়ে এ্যারোপ্লেনে;
নৌকো আর জাহাজেও চড়ে — যায় অফিস পাড়ায়;
দেবদারু গাছ, উড়ন্ত কাকের সারি মুখগুলো দেখে করুণায় হাসে।
অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ সহসা কানকো মেলে বলে ওঠে — আমাদের বেঁধে রেখেছো,
তোমরা তো মরে গেছো কতো শতাব্দী আগে; তোমরা তো পঁচে গেছো প্রেম আর দয়া
পৃথিবীতে থেকে বিদায় নেবার সাথে সাথে — মুখ ফুটে বলে ওঠে বিমর্ষ বনসাই।
মৃত মুখগুলো হেঁটে যায় — স্বপ্নখণ্ডের এক ফালি চাঁদএখনো যে ঝুলে আছে! সবুজ অরণ্য
অভিমুখে কয়েকটি কাক উড়ে যায়―সমুদ্রে চিমনি পোড়ে — চারপাশে মানুষের
মুখগুলো মৃত।
তোমার ঘুঙুর নেই
আলী শাহরিয়ার তুহিন, স্নেহভাজনেষু
তোমার নোলক নেই
তোমার শোলক নেই;
বিগ্রহ
বিভ্রম
বিকার
বিকৃতি এই তো তোমার ছায়া!
তোমাকে বির্দীণ করে নিষাদের তির অরণ্যেআশ্রমে ছায়াপথে চৌরাস্তায়,
তোমাকে ছিঁটোয় থুতু নিশাচর টোটঠেঙ মাঝ রাতে ভেঙে যায় ঘুমের কেয়াঙ;
তোমাকে স্বপনে পোষে যত নাচে অন্ধ যাদুকর;
পুনরায় এই তুমি খণ্ড খণ্ড হয়ে আস্ত জেগে ওঠো মাগরিবে মাশরিকে;
আবার বাজতে থাকে যাদুর মুরুলি —
তোমার ঘুঙুর নেই,
তোমার নূপুর নেই;
ঘুম নেই,
প্রেম নেই,
স্বপ্ন আর সুখ নেই।
অথচ নদীও জানে — তুমি যে নশ্বর,
তোমাকে এঁকেছে সব নগ্ন যাদুকর;
তোমাকে নিকুচি করে মধুপূর্ণিমার রাত, কোজাগরী চাঁদ;
তারারা হারিয়ে গেলে গজল ও গানের মায়ায় চলো ফের
মঙ্গলে তাকাই, মহুয়ার কাছে যাই; উঠোনে আবির ফোটে সুরে, সাহানায়।
রোদের সন্ন্যাস
করতলে এঁটো ফুল,
মজা নদী,
দ্বিখণ্ডিত চাঁদ, মোম ও তুষার;
গেরুয়া গন্ধম ফোটে নাড়ার ঔরসে,
বুকের বেহালা শাঁখ বাউল ও বৃহস্পতি।
আউলাবোয়াল বার বার ভাঙে
জাল ও জলের ঘর,
সমুদ্রের সংসার;
হে সন্ন্যাস,স্বপ্ন ব্যাকুলতা — আনপথে
ছিঁড়ে যাও ঘুড়ির নাটাই,
তোমার সবুজ ডানা মঙ্গলের সিঁড়ি
শেষ রাতে বেজে ওঠে রুহের সানাই।