
আকাশ ইকবাল, মীরসরাই প্রতিনিধি:
[quote font=”arial”]এক ফোঁটা মাটি ফেললে ও আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো: পরিবেশ [/quote]
পরিবেশ আইনকে অমান্য করে মীরসরাইতে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক দীঘি সহ পুকুর জলাশয় ভরাটের মহোৎসব। পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত কয়েক বছরে একের পর এক পুকুর দীঘি ভরাট করেছেন অনেকেই। পরিবেশ আইন থাকলে তা কার্যকর না হওয়ায় কেউ যেন তোয়াক্কাই করছেন না নীয়ম নীতি বা ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি।
সম্প্রতি সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে মীরসরাই দীঘি নামে খ্যাত মীরসরাই পৌরবাজারের দীঘিটি ভরাটের। অথচ এরই পাশ্বেই মীরসরাই থানা, মাতৃকা ও সেবা হাসপাতাল, আরো রয়েছে আবাসিক এলাকা, বাজারের অনেকগুলো মার্কেট সহ জনবহুল বসতি। এই দীঘি ভরাট হয়ে গেলে আগুন লাগলে আসে পাশে আগুন নিভাতে পানি ও নিতে পারবে না ফায়ার সার্ভিস। আবার থানার সকলে সহ আবাসিক এলাকার সকলের বিকল্পহীন ব্যবহার্য্য এই দীঘির পানি।
হাসপাতাল নিকটবর্তি পুকুরটি ও গত বছর ভরাট করেছে উষা নামের ডেভেলপারস। অথচ একের পর এক পুকুর দীঘি ভরাট করে প্রকৃতি বান্ধব এইসব পুরোনো ঐতিহ্য বিলীন করে হাউজিং প্রকল্প গড়তে বাড়ছে ঔদ্যত্ত্ব । এতোকাল কর্তৃপক্ষ নীরব থাকলে এখন পরিবেশ বললেন ওই দীঘিতে এক ফোঁটা মাটি ফেললেই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এবার মীরসরাইয়ের সাবেক এমপি এমএ জিন্নাহ্ তাঁর পিতার স্মৃতি বিজড়িত ‘মীরসরাই দীঘি’ ভরাটের সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছেন। আর এই কাজের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকা খায়রুল ইসলাম রিয়েল এষ্টেট সিন্ডিকেট।
স্থানীয় মীরসরাই পৌর বাজারের দোকানদার ও এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে কয়েকশ বছর আগে থেকে এলাকার লোকজনের নিত্য প্রয়োজনে স্থানীয় জমিদাররা মীরসরাই উপজেলা সদরে বেশ কয়েকটি পুকুর দীঘি খনন করেন। যার মধ্যে অন্যতম ‘মীরসরাই দীঘি’। এছাড়া তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে মীরসরাই কলেজ অভিমুখে এবং মীরসরাই থানা অভিমুখে খনন করা হয় দুই দুইটি পুকুর। গত ২০১১ সালের নাগাদ কলেজ অভিমুখের বৃহদাকার পুকুরটি ভরাট করে ওয়ান্ডারল্যান্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর ২০১৪ সালের দিকে বিএনপির সাবেক এমপি এমএ জিন্নাহর ভাগিনা ঊষা ডেভলাপারস নামে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ভরাট করে থানা অভিমুখের পুকুরটি। বর্তমানে এলাকার বাসিন্দা ও বাজারের দোকানদারদের নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহারের একমাত্র অবলম্বন ‘মীরসরাই দীঘি’। এটিও ভরাটের আয়োজন করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে খায়রুল ইসলাম স্থানীয় জামায়াত সমর্থিত হলে ও আওয়ামীলীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থেকেই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নতুন নতুন বিভিন্ন ব্যবসায়ীক ফন্দি করেই চলেছেন। ইতিমধ্যে ‘মারুফ’ নামক একটি সংস্থার নামে হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ও রয়েছে। সরকারের কোন বিভাগ ও সেই সংস্থা থেকে জবাবদীহি না পাবার অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে উক্ত সিন্ডিকেটের প্রধান খায়রুল ইসলাম ১০ একর আয়তনের ঐতিহাসিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ দীঘিটি ভরাটের সার্বিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছেন। এর জন্য দীঘির পানি সেচে মাঝখানে বাঁশের ভেড়া দিয়ে ঘেরা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় দীঘি ভরাটের পূর্বে বেশ কয়েকজন ক্রেতার কাছে সাফ কবলায় প্লাট বিক্রির বন্দোবস্ত ও সম্পন্ন করা হয়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এতসব জেনে দেখেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রয়েছে নীরব। এতে স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দীঘি ভরাটের আয়োজন করছে ওই সিন্ডিকেট।
জানা গেছে ঐতিহাসিক এই দীঘির প্রকৃত মালিক পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী ও মীরসরাইয়ের সাবেক বিএনপির সংসদ সদস্য এমএ জিন্নাহ্র বাবা মাহফুজুল হক। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানেরা উত্তরসূরি হিসেবে মালিক হন। বর্তমানে এমএ জিন্নাহ্ এবং তাঁর ভাই বোনদের ম্যানেজ করে ডেভলাপারস কোম্পানীর মাধ্যমে পুকুর ভরাট করে প্লট বিক্রির প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে।
অবশ্য দীঘি ভরাট নিয়ে সাংবাদিকেরা তাঁর সাথে কথা বললে সাবেক এই এমপি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘ আমার অংশে আমি মাচ চাষ করবো তাই আমার কয়েকজন প্রতিনিধি বেড়া দিয়েছে।’
বাণিজ্যিক এপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে ঐতিহাসিক এই দীঘিটি ভরাটের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন এমএ জিন্নাহর প্রতিনিধি স্থানীয় শেখ আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘দীঘির মাটি শুকালে ভরাট করা হবে। এখানে বাণিজ্যিকভাবে এপার্টমেন্ট তৈরি করা হবে।’ সংস্লিষ্ট পৌরসভা, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে শেখ আহম্মদ বলেন, ‘পৌরসভায় আমরা আবেদন করেছিলাম, এতে হবে না। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’ আবার খায়রুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন দীঘির স্বত্ব মালিক আমি নই, আমার তো বিক্রির ক্ষমতা নেই, যিনি মালিক তিনিই অবগত।
মীরসরাই পৌরসভার মেয়র এম শাহজাহান বলেন, ‘দীঘির অন্যতম অংশিদার সাবেক এমপি এমএ জিন্নাহ্র প্রতিনিধি শেখ আহম্মদ ভরাটের অনুমতির জন্য পৌরসভায় আবেদন করেছেন। আমি পরিবেশ ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে তাকে পরামর্শ দিয়েছি।’
দীঘি ভরাটের বিষয়ে পরিবেশ অধিপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘দীঘি কিংবা পুকুর ভরাটের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। ওই দীঘিতে এক ফোঁটা মাটি ফেললেই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
মৎস্য ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন কারিতাসের সাবেক নির্বাহী পরিচালক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘১৯৫১ সালের পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোন মৎস্য উৎপাদনকারী পুকুর দীঘি পরিবেশ ও মৎস অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া ভরাট করা যাবে না।’
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, পুকুর ভরাট, দিঘী ভরাট এগুলো জলধারা আইনের ভেতর পড়ে। সেই হিসেবে এটি অপরাধ। সব চেয়ে বড় কথা হলো এই আইন ২০০০ সালে তিনিই গঠন করেছেন।