বয়েসী পুল
ভাঙ্গা পুল জানে-
শেষঅব্দী নদী তার আপনার লোক ।
কত-কত মাইল বয়েসী পুলের গায়ে-
আজো নদী রাখে শুশ্রুষা-রোদ
পরায় জোৎস্না পিরাণ ।
কালভার্ট দুঃখ নিয়ে
বিলাপের সুর আজ কতোটা প্রগলভ
ভাঙ্গা পুল বিভ্রাটে……
অথচ-
সে যেকোন ঋতু বা শস্যের গান-
বুকে কোরে নিয়ে যেতো অন্য গ্রামে,
ভাটায়-উজানে …
চন্দ্রমল্লিকা
এইসব আন্ধা-সন্ধ্যার ঢামাডোলে-
হতে পারে একটি বরফের ছুরি আঁড়পাড় করে-
তুমি খুন হলে।
বরফ গলে যাওয়ার আগেই-
ঝরে যেতে দেখলাম বৃন্তচূত্য সবকটি চোখ,
থ্যাতলে পরলো নরম রোদ-শুকা গন্ধ ।
মনে পড়ে, চৈত্রবাসে হাওয়ার মাখামাখি-
এড়িয়ে যেতে খুব।
অথচ রাতের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে- জানলায় দাঁড়িয়ে বলতে-
প্রকৃত পাহাড় কখনও তুফান ভোলেনি।
ঘাসঘর-কাটানদী- ফালি ফালি ঢেউ
কোনদিনও জানবেনা-
তোআজসারাদিনই নদী
আজ-সারাদিনই নদী,
আড়ায় পাড়ায় ঘুম ঘুম গান ।
তবু ধমনীতে কৃষ্ণচূড়া খলবলিয়ে ফোটে,
দূরের গাঁয়ের গন্ধ চিনে নিতে ।
কে যেন গাঁয়ের সুহৃদ আমার,
হলুদ খামে ভরে পাঠালো
নদী ভেজা ১২ পাতা বন।
পাতায় পাতায় কুয়াশার দাগ লেগে ছিল
ঘাসের ঘর ছিল
রোদ রোদ ওম ছিল
আর ছিল-
ঘননীল আগুনের ছায়া ।
বিলগন্ধী ডিঙ্গি ছিল
কাঁসা রঙা সন্ধ্যা ছিল
ছিল আসমানী
পালকের অহরহ খসে পরা ।
আজ-
সারাদিনই নদী,
ঘুরে-ফিরে ঘুম ঘুম গান…
মার পিতার নাম হুয়ান পাহাড়।
সেলুকাস
একটা অনুচ্চারিত বিকেল হেঁটে এলো
ঘোলা জলের দাগ নিয়ে; শহরতলিতে ।
আমরা ততক্ষণে মরা ফড়িঙের পাখনা মারিয়ে
চা-চক্রে চামচের টরে-টক্কা।
আমাদের পায়ের নীচের খয়েরি ঘাসগুলোও দৃশ্যত
বিগত বৃষ্টি শুনল দাগের চিহ্ন দেখে।
ধোঁয়ামন্ত্র পাকে পাকে বিশ্বাসী হতে দিল জারুল পাড়ে;
অথচ আমরা জানতাম- জীবন জঙ্গম ।
বর্ষোপল
শুনেছি বৃষ্টির কিছু পাহাড়ী ধুন আছড়ে পড়ে সমুদ্রের পায়ে মঞ্জীর গড়ে
এ কোন বাসাড়িয়া বর্ষোপল !চূর্ণ কাঁচের শ্বাস তুলে নিয়ে ভাসায় দ্যুনিশ……
থেকে থেকে সাদা ফুল নেভে- জ্বলে ভীষণ রাতের পয়ারে
আমি প্রবল বিদ্যুল্লতায় আকাশের ধনিষ্ঠা চিনে রাখি নিদাঘ অসুখে ।
এসব স্নেহনাম্নী বর্ষা শেষে-
শহরের আনুপূর্বিক ময়ূরারি যেদিন শুদ্ধ হবে-
পাতার পলালে ফুটবে নদীধোয়া বিস্মৃত বাতাসের আহির ।
শূন্যবলয়
বেদুঈন ঘোড়ার খুর থেকে ঝরে পড়া বালির মতো
আমার সকাল- সন্ধ্যা ঝরে ঝরে যায়
তোমাদের নির্ণিত ব্ল্যাকহোলে ।
এখানে বৃষ্টি নেই,
পোয়াতি গাভীর মতো কোন নদী দেখেনা পাঁকা মেঘ ।
শহুরে ইটের পাঁজর নিংড়ে শিরায় ধাবিত ঘামের মতো
গ্যালন গ্যালন উচ্চাশা-
ছিপি এঁটে তুলে রাখি সোকেজে ।
মাঝে মাঝে ধুলা ঝেরে হাত বুলাই প্রিয় বিড়াল ভেবে।
এখানে ফুলেরা মৃত,
কফিনের ঘ্রাণ নিয়ে বাজারী ব্রক্ষচারী ।
রাস্তাকে নদী ভেবে সাঁতরেছি বহু পথ-
ঘোলা মানুষের উজান ভেঙ্গে ।
খুঁজেছি পাতার পতন-
শাহরিক খাদে তলিয়ে যেতে যেতে ।
এখানে জংলা নেই,
রৌদ্রদাহে টগবগিয়ে ফোটেনা সবুজ ।
প্যাঁচপ্যাঁচে ইমোশনাল মুজিব পরদেশী
ট্রাঞ্জিস্টার স্মারক হয়ে হারিয়েছে কবে ।
হাড়গুলো তবুও-
কালা হয়ে হয়ে ছাইগাদা হয় ।
এখানে দুধদাঁত কামড়ে ধরেনা মাতৃস্তন-
ঘুমন্ত শিশুদের কান্না-হাসি নিথর পড়ে থাকে ডে-কেয়ার হোমে ।
সরল শীতের ওমে জমে থাকা ট্যাংড়ার ঝোল ভেবে-
গিলেছি রাশি রাশি রেডিমিক্সড স্যূপ ।
রঙ্গিনতর রাতের নেশায় উগড়ে দিয়েছি
কিছু আধ-ফোটা শিউলির ভোর,
হাওয়ায় দুলতে থাকা শসার মাচান ।
এখানে উঠোন নেই,
বাড়িগুলো পাতালে শেঁকল বাঁধা হিরামন পাখি ।
হয়তো একদিন তোমাদের নির্ণিত ব্ল্যাকহোল
সমস্ত মৃত তারার স্মৃতি নিয়ে
উবে যাবে সময়হীন দ্বৈরথে- শূন্যবলয়ে ।
তুমি- আমি, আমি- তুমি কতোখানি চিরতর হয়?
অজাতশত্রু
সোনা সোনা মনজিসে গুরো হাড়ের প্রলেপ লাগলে মাংসের কথা তোল তুমি–
বোতলভর্তি অনঙ্গ সৌরভ, অথচ প্রস্ফুটন নেই !
শহরের স্থিরচিত্রে তুমি ক্রমাগত উদ্ধত, এফোঁড়-ওফোঁড় কর বিকেলের মৌতাত–
বাতাসের বনে বাইসন নামাও রোজ । তোমার পায়ে লাগে অজস্র কৃষ্ণচুড়া– ভ্রুক্ষেপহীন ।
ডানায় লেগে থাকা জল সিঞ্জনে তৃপ্ত পিঁপড়ের ঠোঁটের মতো ফোঁটা ফোঁটা একেকটি দিন-
পকেট উপচে পড়ে, যতসব বেখেয়ালে– উড়ুক্কু চুলের রুক্ষতায় লেখা থাকে সব ।
তুমিই একান্ত অজাতশত্রু, চির আকাশসঙ্গমে !
ব্যাকবেঞ্চার
আমরা আবার বৃক্ষবিদ্যালয়ের লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসি– অমনযোগী ঘাসের সমান্তরাল ।
দৃষ্টি নিবদ্ধ থাক সারি সারি অরহরের বাউলিপনায় ।
বৃষ্টির নন্দনতত্ত্বের সবগুলো পৃষ্ঠা জুড়ে থাকবে আমাদের কাটাকুটি খেলা ।
প্রতিটি পাখির ডানায় সম্পাদ্য উড়ে গেলে আমরা ভাবব সবুজবৃত্ত, গাঁয়ের বুকে জেগে থাকা
শত শত ট্রাপিজিয়াম ঘর ।
শস্যসংঘাতময় দীর্ঘ কবিতা মাঝপথে ভুলে গেলে আমরা সেকবির নিজস্ব সমুদ্রে দেখে নেব-
লোনা অক্ষর ! তীব্র সূর্যের দিকে তাক করা আমাদের সরল ভ্রু ভুলে যাবে সকালের রোলকল ।
অনেক ক্লাশের ক্লান্তি পেরিয়ে কখনও চলে যাব সে নদীর কাছে, জামায় লেগে থাকা সমস্ত দাগ নিয়ে–
যা্র জল আয়নায় আমরা শিখবো ঢেউ ।
জাহাজীসন্ধ্যা
মসলার কল থেকে ছুটে আসা যাবতীয় গন্ধ
বিগত শীতের রোদ পরিবাহী ; জনান্তিক পাখির বন্দিশে ।
বৃষ্টির ঘন শ্বাস পিচ্ছলে পড়ছে সে ঠোঁটে এমন;
যেন সাহিল সঙ্গমে পতিত বন্দর এক ।
আগেও এমন নিজেকে দিয়েছি ছুড়ে মসলা গলিতে বহুবার;
হেঁটেছি পতিত বন্দর; ছোট ছোট ঘুমন্ত ঘরের চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে…
একঘেয়ে লোনা বিকেল জং ধরেগ্যাছে কবে
আমি ছিলাম অথবা নেই; মনে পড়ে না ।
তারপরও মাঝে মাঝে জাহাজীসন্ধ্যাগুলো আমাদের মদে ডুবে থাকে…
দুটি জানালা ও স্যডিস্ট
জানলাদুটি খুব পাখি ওড়ালো- মেঘ বোঝালো
আর দুরন্ত শিশুকে দিয়ে গেল ঘুম, মার্বল দিনে ।
ভাবছি ওপারে লেবুগন্ধী রোদ কতটা পেরুলোপথ-
আমার চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে ।
জানলা দুটি খুব কথা বলে গেল- অনর্গল, বাসের চাকার মত
তখন ভাবছি তীব্র বাতাসে লন্ডভন্ড কালো জংগল-
অথচ হিংস্রতা নেই কোথাও।
জানলা দুটি হঠাৎ স্নেহমাখা শাসন করল- অভিমান শেখালো
আর মায়ের মতই চোখ-মুখ-শরীর জুড়ে অজস্র চুমু খেতে লাগল।
আমি প্রচন্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে উঠে গেলাম
আর আকাশের বুকে সজোরে আঘাত করি রাত্রি নামুক…