[english_date]

ভোটাধিকার থাকলে ছাত্র সংসদ কেন থাকবে না?

দেশের কয়েকটি শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলো যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সে সম্পর্কে পাঠকের মতামতটি পুনরুল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তাঁরা প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, অবিলম্বে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হওয়া জরুরি।

সেই সঙ্গে পাঠকদের কাছ থেকে একটি নালিশও এসেছে, আমরা কেন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলাম? এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (বাকসু), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ (ইউকসু) অন্যান্য ছাত্র সংসদ নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রয়োজন।

তাঁদের এই নালিশ অযৌক্তিক নয়।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে ২৬-২৭ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়া সুস্থতার লক্ষণ নয়। আমরা নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির নির্বাচনও নিয়মিত হয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করেন, সেই নেতারা সরকারের সঙ্গে দাবিদাওয়া নিয়ে দর-কষাকষিও করেন। বছর দুই আগে সরকারি বেতনকাঠামো নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে।

কিন্তু যাঁদের কেন্দ্র করে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেই শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। অথচ নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকা যে কত জরুরি, সে বিষয়টি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আদালত বলেছেন, কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপূর্ণাঙ্গ সিনেটে যে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছে, সেটি অবৈধ। সিনেট পূর্ণাঙ্গ করেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে হবে। আর সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিকল্প নেই।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ১০৫ সদস্যের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি পাঁচজন, যাঁদের মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচিত ছাত্র সংসদের। রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য তাঁর ক্ষমতাবলে বর্তমানে আখতারুজ্জামানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী সেখানে একজন স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ দিতে হলে সিনেট পূর্ণাঙ্গ করেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে হবে। আর সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে হলে ডাকসু নির্বাচন করতে হবে।

একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে চাকসু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে জাকসু নির্বাচন করতে হবে। আদালতের এই রায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রশ্ন রেখেছিলেন, তাহলে ১৯৯১ সালের পর গঠিত সব সিনেটই অবৈধ হবে কি না? তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, এ ধরনের যুক্তি দিয়ে কি ভবিষ্যতেও অপূর্ণ সিনেট নিয়ে আপনারা উপাচার্য প্যানেল করতে চান? অতীতকে আমরা বদলাতে পারব না। তাই বলে ভবিষ্যতের পথ কেন বন্ধ করব। এ ব্যাপারে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয়, শিক্ষকদেরও দায়িত্ব আছে। তাদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু নির্বাচন করেই একটি উপাচার্য প্যানেল তৈরি করে একজন স্থায়ী উপাচার্য বেছে নেওয়া।

ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন দেশের ১ নম্বর নাগরিক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গত মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ এ মাস্ট।’ যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে রাষ্ট্রপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করাই নিয়ম। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি লিখিত ভাষণের বাইরেও কিছু কথা বলে থাকেন, যা সচরাচরই রাজনীতিকদের মুখে শোনা যায় না। তিনি মানুষের মনের কথা বলেছেন। মনে পড়ে, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদও অনেক সংকটময় সময়ে লিখিত ভাষণের বাইরে এমন কিছু বলতেন, যা জাতির বিবেককে নাড়া দিত।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন না হওয়ার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহসের অভাবকে দায়ী করেছিলেন। আর এ বছর ২৯ মার্চ সচিবালয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসায় স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন-২০১৭ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার ব্যাপারে আমরা শিক্ষকদের (কর্তৃপক্ষ) কাছে আবেদন করেছি। তবু কেউ সাহস করে নির্বাচন দেয় না। তারা তাদের আইন (বিশ্ববিদ্যালয় আইন) অনুযায়ী চলে।’ রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ব্যাপারে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমরা তাদের (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ) উৎসাহিত করছি। কিন্তু আমরা তো আর সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।’

রাষ্ট্রপতির তাগিদ এবং শিক্ষামন্ত্রীর উৎসাহ জোগানোর পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস না পাওয়া বেদনাদায়ক। একই সঙ্গে রহস্যজনক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চপদে কেন সরকার বেছে বেছে এত ভীরু মানুষকে বসায়, যাঁরা রাষ্ট্রপতির তাগিদ ও শিক্ষামন্ত্রীর সাহস জোগানোর পরও সাহসী হতে পারেন না। তাঁদের খুঁটি কোথায় বাঁধা, সেটিও হয়তো বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অতিসম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের একটি উপকমিটিতে চার-চারজন উপাচার্যের নাম দেখে প্রথম আলো অনলাইনে লিখেছিলাম, ‘উপাচার্যরা এ কোথায় চলেছেন?’

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ