মুশফিক হোসাইন
আগ্রাবাদস্থ বাণিজ্যিক এলাকার যমুনা শিপ বেকার্স ভবনের ১০তম তলার নামাজ ঘরে যিনি ভুল করে ঢুকে পড়েন, তিনি আর কেউ নন, একজন লক্ষ্মী পেঁচা। যার ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে লক্ষ্মী পেঁচাটি ভিআইপি মর্যাদার। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আসমত -এর বক্তব্যও ছাপা হয়েছিল। মোটামুটি প্রিন্ট মিডিয়ার বদলৌতে লক্ষ্মী পেঁচার প্রসঙ্গটি নগরবাসীর আলোচনায় উঠে আসে। বিষয়টি অনুপ্রেরণামূলক। পাখির প্রতি মানুষের মমত্ব বাড়বে। ভালই হলো, পাখি যখন দেখা যায় না এই কসমোপলিটন নগরে। তখন পেঁচা প্রসঙ্গটি মানুষকে কৌতূহলী করবে এতে সন্দেহ নেই।
আসুন আমরা লক্ষ্মী পেঁচাকে আর একটু জানি। লক্ষ্মী পেঁচা আমাদের স্থানীয় পাখি। পেঁচা গোষ্ঠী বিশ্ব বিস্তৃত হলেও অধিকাংশই আবাসিক। পৃথিবীতে এ প্রজাতির সংখ্যা ৮০টি। উপমহাদেশে ২০টি প্রজাতির মধ্যে কমবেশি ১৮টি প্রজাতি আমাদের দেশে দেখা মেলে। তার মধ্যে লক্ষ্মী পেঁচা, ভূতুম পেঁচা, খুরলে পেঁচা ও কুটরে পেঁচা এই চার গোত্রে ভাগ করা হয়। মানুষ যেমন পূর্ণচন্দ্রালোকে দেখতে পায় পেঁচাও তেমনি নক্ষত্রের আলোতে দেখতে পায়। পেঁচা নিশাচর পাখি। পেঁচার চোখ শুধুই বড় নয়, এদের আছে বিশেষ ধরনের রেটিনা। যার ফলে গভীর অন্ধকার রাতে এরা দেখতে পায়। শিকারী পাখির মতো এদের চোখ দুটি সামনে হওয়াতে এরা অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়। কিন্তু পাশে দেখার জন্য পেঁচাকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে হয়। এ ছাড়া মাথা কাত করে পেঁচা উপরে নিচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, যখন আপনি পেঁচার দিকে তাকাবেন, দেখবেন, সে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আপনাকে ভয় দেখাচ্ছে। লক্ষ্মী পেঁচা (BARM OWL বৈজ্ঞানিক নাম TYTO ALLOO) এক সময় দেশে প্রচুর দেখা যেত। নগরায়ন, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে এরা এখন কমে যাচ্ছে। তবুও সুলভ বলা যায়। পেঁচা জাতিদের মধ্যে সবচে সুন্দরতম হলো লক্ষী পেঁচা। যার মুখ ধবধবে সাদা-হৃদয় আকৃতির। চেহারায় কৌতুক কৌতুক ভাব। এদের মুখের গড়ন পৃথিবীর অন্য কোন পেঁচার সাথে মিলে (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ছাড়া) লক্ষ্মী পেঁচার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের চেহারার সাথে বানরের মুখ মন্ডলের সাথে মিলে যায়। গায়ের রং বাদামী বা সোনালী বাদামী। তার উপর সাদা গাঢ় চিতি। গলা পেট এবং পা থেকে বুক পর্যন্ত সাদা বিস্তৃত। চোখ কালো, চকচকে। পায়ের আঙুল হলুদ। ঠোঁটের পাশে গোঁফের মতো অতি সুক্ষ্ম টান চলে এসেছে ঠোঁটের গোঁড়া পর্যন্ত।
শরীরের তুলনায় মাথা রড়, গোলগাল, এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। কোন প্রতিবন্ধকতা না হলে এরা বছরের পর বছর একই এলাকায় বসবাস করে। ভাঙা বা অব্যহৃত বা পরিত্যক্ত দালানকোঠা, গাছের ফোকরে বাসা করে। দৈর্ঘ ৩৬ সে. মি.। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা সামান্য বড়। অন্যান্য পেঁচাদের মতো সাধারণত: দিনের বেলা বের হয় না। অন্ধকার স্থানে চুপচাপ নিজেকে আড়াল করে বসে থাকে। সন্ধ্যার সাথে সাথে খাবারের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। শীতের প্রারম্ভে এরা বাসা বাঁধে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৫/৭টি ডিম দেয়। ডিমের রঙ সাদা ও গোলাকার। বছরে দুবার ডিম দেয়। দু’জনে পালা করে ডিমে তা দেয়। দিনের বেলা অনেক সময় এক সঙ্গে ডিমে বসে তা দেয়। ডিম ফোটে ৩০-৩৫ দিনে। বাচ্চা কিঞ্চিত বড় হলে চিৎকার করতে থাকে খাবারের জন্য। ছানাদের বয়স মাস খাকেন হলে ওরা বাসা থেকে বের হয়ে আশে পাশে ঘোরাফেরা করে। মা-বাবা খাবার নিয়ে এলে ঠেলাঠেলি এবং চেঁচামেসি করে থাকে। ছানারা উড়তে ৫০-৫২ দিন সময় লাগে। আরো ৩০-৩৫ দিন মা বাবার সাথে থাকে তারপর আলাদা হয়ে পড়ে। নতুন উড়তে শেখা ছানারা একটু বোকা প্রকৃতির। মানুষ, কাক, চিল ও অন্যান্য পাখির কবলে পড়ে যায়।
পেঁচারদের মূল খাদ্য ইঁদুর। এছাড়া কাঠবিড়াল, ছোট সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, ছোট পাখি, চামচিকা, পাখির লক্ষ্মী পেঁচার পছন্দ। তবে ধেনো ইঁদুর এদের খুব পছন্দ ও প্রিয় খাবার। তাই এরা কৃষকের পরম বন্ধুও বটে। পেঁচার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি অতিময় প্রখর। উড়তে পারে নিঃশব্দে। ওরা শ্রবণশক্তি দিয়েই শিকারের নড়াচড়ার সঠিক জায়গাটি অবলীলায় সনাক্ত করতে পারে। দুরন্ত শিকারী ও ওড়ায় দক্ষ। এরা যখন ওড়ে তখন ডানার নিচের সারা রঙ চোখে পড়ে। এদের পালকগুলো মথমলের মতো নরম ও পেলব। ডানা লম্বাটে। লেজ ছোট আকারের। অন্য পেঁচাদের মতো এদের চোখ বড় বড় নয়। সাধারণত সন্ধ্যার পর ডাকে। অন্ধকার রাতে নির্জনে পেঁচার ডাক ভয়-জাগানিয়া। তবু এরা মানুষের প্রকৃত বন্ধু। এদের কারণেই মানবজাতি প্রচুর পরিমাণে শষ্যহানি থেকে রক্ষা পায়। হিন্দু সম্প্রদায় লক্ষ্মী পেঁচাকে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর বাহন মনে করে।
বাংলাদেশের সর্বত্রই এদের দেখা যায়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশে এদের দেখা মেলে। বাংলাদেশে লক্ষ্মী পেঁচা ভালোভাবে বেঁচে আছে। খাদ্যাভাব নেই। তবে বাসা বানানোর সংকট দিন দিন বাড়ছে। বড় বড় গাছ আর পরিত্যক্ত দালাল কোঠা এখন দুর্লভ। পেঁচা সাধারণত ১৫-২০ বছর বাঁচে। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। লক্ষ্মী পেঁচা বেঁচে থাক বাংলাদেশে, সাহিত্যে সংস্কৃতিতে। হয়ত সেই মমতা থেকে জীবনানন্দ লিখেছেন: “ভেবে ভেবে ব্যথা পাবো;-`মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকতাম বেঁচে/দেখিতাম সেই লক্ষ্মী পেঁচাটির মুখ যাবে কোনদিন ভালো করে দেখি/নাই আমি’/এমন লাজুক পাখি, ধুসর ডানা কি আর কুয়াশার ঢেউয়ে উঠে নেচে;/যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গায়ের নিবিড় বুকে আসে/সে কি নামি?”
আলোচ্য ভিআইপি লক্ষ্মী পেঁচাটি চট্টগ্রামের আশেপাশের কোথাও থেকে উড়ে এসেছে। চিড়িয়াখানা নয়, একে প্রকৃতিতে মুক্ত করে দিলে ভালো হতো। সে প্রজননের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতো তার বংশধর।