মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ
মেটে মালসার ফুল
ভালোবাসা বেপরোয়া, জানবাজ — অনায়াসে হাত রাখে গোখরো ফণায়
— কানুন মানে না।
সহজে তরিকা ভুলে অন্ধকারে ঘাই মারে জেনানাকোরাল;
‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে নদীতে নোঙর ফেলে নিমগ্নসারেং
শরমিন্দা জলে বাজে ভেজা বাঁশপাতা; বানডাকা বাঁশি।
চলো, ভালোবাসাটুকু উঠোনে শুকিয়ে নিই সোনালি বীজের মতো
আষাঢ়ে ভিজতে দিই―করে তুলি সবুজঅবুঝ অমলধবল গঙ্গাকইতর
ভুলেভালে পোড়াতে পোড়াতে খাঁটি করে তুলি শরাহত সোনার মোহর;
চোঙায় ফুঁ দিই―বিরহ ও অভিমানে চকচকে করি অঙ্গারের অহঙ্কার,
মেটে মালসার ফুল।
মুস্তফা কামরুল আখতার
সমুদ্রে শুধুই জলের সন্ধান
এক বন্যা ও সমুদ্রের কথা বলি ?
কথাগুলো গোছাতে গিয়ে আরও এলোমেলো হয়ে যায় ৷
আরও বেশি দুর্বোধ্য এক বেসুর দিন-দুপুর আমার
ভুল রঙে তোমার ছবি বানায় ৷
তবুও ঘুরে দাঁড়াই, টের পাই,
নির্জন এক বন্যা শতাব্দীর পথে হেঁটে হেঁটে
নিঃশব্দে এসে দাড়িয়েছে তোমার খোঁজে ৷
পরিযায়ী বন্যা পাহাড় ডিঙ্গায় ৷ নেমে আসে
কঠিন পাহাড়ের উপর হতে ৷
উপচানো বন্যা বুকে নিয়ে এগোই,
জন্মান্তরের তৃষ্ণা নিয়ে জলের খোঁজে ।
আর জল ? জলের ছলে বন্যাকে বয়ে যেতে দেয়,
তখন বলি, নদী আর সমুদ্র !
অথবা গহীনে ক্রন্দন ৷
তবুও অচেনা মানচিত্রে চেনা পাখি ডানা ঝাপটায়,
তবুও দুলে ওঠে নিপুণ সাপুড়ে বীণ ৷
আমি তখন মোহনায়, সমুদ্র সামনে ৷
সমুদ্রে শুধুই জলের সন্ধান ৷
দেবাশীষ মজুমদার
এবং অবন্তিকা
১
ভূগোলে আমি চিরকাল কাচা, গোল শব্দটা দূর্ধর্ষ লাগে, ঠোঁট গোল করে বলতে হয় গো-ল, তবু যাবতীয় গোল নিয়ে কথা হবে অন্যদিন, আজ ভিন্যকিছু হোক, এই যেমন ধরো কিম কি দুক কতোটা দুখি ছিল, পিয়েতা সিনেমাটা তার ব্যক্তিগত গল্প এমন ধারনাকে আমি পাত্তা দেইনা, এখানে ‘মা’ আছেন, মা কারো ব্যক্তিগত হতে পারেনা । কিংবা আমরা আলাপ করতে পারি এমন বর্ষাকাল আমাদের সিলেবাসে নেই, খিচুড়ির লোভে জিভে জল আসে তবু, যদিও জানিনা আঙুল চুষবার বিবিধ টেকনিক। অথচ এই যে বৃষ্টি তারাও কমন পড়ে, অফিসের প্রৌঢ় কলিগ বহুবার দেখেছেন – এমন কথা শোনাবার পর সিগারেট জ্বালালেন, তারপর কেমন বেভূল হয়ে গেলেন! আমি তাঁর চোখের গোলককে গাঢ় হতে দেখতে পেলাম, তাঁর সামনে রাখা চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ছে, আর পিরিচে জমছে কোকিলের ডাক, জলবিম্ব, আকাশবিভ্রম, তারই মধ্যে পাতাবাহারের গল্প।
এমন বৃষ্টি জীবনে আমিও দেখেছি কিছু। এই সমস্ত জলেরা অসভ্য ভীষণ । চুল থেকে কপাল, চোখ, নাক, ঠোঁট ছুঁয়ে হুইসেল বাঁজিয়ে ছুটে যাচ্ছে অন্তঃপুরে সুবর্ন এক্সপ্রেস। টুপুর সকালে আমাকে জাগালো সে, রাহাজানি করে ফেলছে আস্ত একটা টাপুর দুপুর। হ্যাচকা টানে বিকেলটাকে বড় করে ফেলে যদি আমি বলি –
আমার কোন শাঁখা নেই, একা
তুমিও কি নও অবন্তিকা?
শরীর শিখছে প্রতিটি মানিয়ে নেয়া, উৎরাই চিনে নিচ্ছে অচেনা আলাপ । কতোটা সুখ ডুবে আছে নিপাট ভুলে যাবার গল্পে! চেতনার প্রতিটি প্রান্তরে ক্রমশঃ ভোকাট্টা হচ্ছে মুগ্ধতা,ঠোঁটের গন্ধে আরও নির্জন এক একটা দীর্ঘশ্বাস। যদি বিনয়ের মতো বলি ‘ফিরে এসো চাকা’, তুমি কি বলবে – চাকাটাও গোল? গোল এর আলাপ হবে অন্য কোন দিন।
ধুর ছাই …
২
নাটকের নাম হরিণ, চিতা, চিল; তখন মা-বাবা’র কাছে
সম্পর্ক লুকোবার দিনগুলোতে মহড়া কক্ষে বেশ আগেই
চলে আসি রোজ এমনই চিতা আমি, হরিণ জানতো
ইন্ধনে আগুন হই, অজানা নারীর গন্ধে শূন্য স্থানের দিকে
বারবার ধেয়ে যাই, যাচ্ছেতাই ডুবুরী সিনড্রোম।
জেগে উঠেছিল পুরাতন পৃথিবীর ঠোঁট, অক্ষরের ব্যূহ
সাজিয়ে আটকে ফেলেছিল তুমি, যদিও তখনো আমি
কোন অভিমন্যু নই, মৎস্য রাজকন্যারা কেবলই পরিসংখ্যানে
ঝুলে আছে, সম্ভাবনার রোদ হামা দিচ্ছে এদিক-ওদিক, তবু
ভুলে ভরা কুয়াশার জ্যামে আটকে সাংকেতিক সেতু পেরিয়ে
চাঁদের পাড়ায় ঢুকতে পারিনি।
তারও বহুদিন পর পৃথিবীর কোঁচকানো এ পীঠে বহুদূর
মসৃণ দেশ থেকে তুমি জানালে –
অল্ট কন্ট্রোল ডিলিট চেপেও সম্পর্কের গা থেকে ভরসা
শব্দটা ডিলিট করা যাচ্ছেনা, কেন বলতে পার?
অবন্তিকা,
আমার চারদিক ছাপিয়ে এখন বৃষ্টির ঠুমরী, টুপুর
জমছে পরতে পরতে ফসিল গোলাপের সাথে, এই
স্বাভাবিক স্বার্থকে ভালবাসা বলে।
আর,
তোমার পুরনো তরুণী ওড়না জুড়ে বসে আছে একটা
আপাদমস্তক ভেজা চিল, তুমি তাকে জাপটে ধরে থাকো-
একদম, জাপটে ধরে থাকো।
কচি রেজা
নাকি আমি কোনওদিনই দেখিনি তোমাকে
ঠা ঠা রোদের ভিতর দাঁড়িয়ে এখন আর মনে পড়ে না আমিই প্রত্যাখান করেছিলাম
নাকি তুমি । যেমন মনে পড়েনা , নায়াগ্রার অতিকাছে গিয়েও কেন দেখা হলোনা সেই
আশ্চর্য প্রপাত , নাকি আমি কোনওদিনই দেখিনি তোমাকে , যেমন দেখিনি পামিরের
মালভূমি অথবা পারস্যের ঝুলন্ত উদ্যান !
মানছি , আমি এক তাতারের জারজ স্বপ্ন । স্বপ্নতাড়িত পিতার চরম ব্যর্থ সন্তানও । যার
হালকা অন্তর ভারি হয়ে গেছে যাপনকে ধারণ করে , আর যাপনের দেওয়াল যার
কালো কালো পরদায় ঢাকা ।
বেদনা ব’লে কিছুর প্রবেশাধিকার নেই সেখানে , যেখানে আনন্দ পরম নিষ্ঠুর !
দুইহাজার বছর আগের মমিতে আমাকে দেখেছ ? তাই রক্ত নেই আমার ?
তুমি রক্তময় ব’লেইতো আমি দুপুরে ফোটা মোরগফুল রঙে আমূল আপ্লূত হই !
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের অসমান স্নান দেখি । ভাবি , জীবনটা উলটে দিলেই , কী বিশাল
উত্থান , হয়তো বা !
অনুপমা অপরাজিতা
চাঁদের জলে ফাগুন
হঠাৎ ওয়েবে ভেসে এলো
পয়লা ফাগুনের বাসন্তিবার্তা
অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার রূপোলি সিকি
অদ্ভুত আর নিপুন রঙে ছুঁয়েছে ব্যাকুলতা
প্রসারিত কারুকাজ মনদেহলি তাথৈ তাথৈ
অদেখা বিচ্ছুরণ সুপ্রসন্ন চাঁদের জলে
ধবল হাঁসের সাঁতার পুলকে পুলকে
মনের রেলিং ধ’রে ভরা পূর্ণিমার নির্যাসে
ভিজে যায় গোপন বাসনা নিসর্গের অতলে
বসন্তমাধুরী ধারা কা’র পুস্পপাত্রে উছলিয়া
ভ’রে নিলো আকুলতা বাজায়ে নীলমণিলতা ।