৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ব্যাট ভারতের, বল ভারতের, তাদের খেলায় না নিলে কীভাবে কী হবে?

ঘুরেফিরে সেই পুরনো কাসুন্দি আর কী! ২০২৩ এশিয়া কাপের আগের নাটক মনে থাকলে আপনার এখন ‘দেজা ভ্যু’র অনুভূতি হবে।
সেবার পাকিস্তানের আয়োজনে হয়ে যাওয়া এশিয়া কাপে ভারত দল না পাঠানোর ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া ছিল, পাকিস্তান শুরু থেকে এ নিয়ে অনেক হম্বিতম্বি করলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের ম্যাচগুলো এবং সেমিফাইনাল-ফাইনাল শ্রীলঙ্কায় দিয়ে ‘হাইব্রিড মডেলে’ রাজি হয়েছিল। তাতে এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, ১৩ ম্যাচের টুর্নামেন্ট এশিয়া কাপের কাগজে-কলমের ‘আয়োজক’ পাকিস্তানের মাটিতেই ম্যাচ হয়েছিল মাত্র ৪টি!
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে এবার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে সূচিতে নির্ধারিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে নাটকে চলে আসুন। এবারও টুর্নামেন্টের আয়োজক পাকিস্তান। ভারত আগে থেকেই মৌখিকভাবে জানিয়ে এসেছিল, তারা দল পাঠাবে না পাকিস্তানে। কিন্তু মুখের কথায় কাজ হয় না বলে পাকিস্তানের দিক থেকে লিখিতভাবে জানানোর নির্দেশনা এসেছিল। আইসিসি দিন দুয়েক আগে পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডকে (পিসিবি) জানিয়েছে, ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) পাকাপাকিভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা পাকিস্তানে দল পাঠাবে না।
ভারতের দিক থেকে এ খবর জানার পর পাকিস্তানের দিক থেকে আবার হম্বিতম্বি শুরু হয়েছে। সেই এশিয়া কাপের মতো নাটকই হচ্ছে আর কী! গত কিছুদিনে এ নিয়ে চলতে থাকা নাটক ক্রিকেটপ্রেমীমাত্রই জানেন। কিন্তু বিশ্লেষণ কী বলে? ভারত যদি পাকিস্তানে যেতেই না চায়, তাহলে কী হতে পারে? ভারতকে ছাড়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করা যায় না? ভারতের অনুরোধ মেনে তাদের ম্যাচগুলো আর সেমিফাইনাল-ফাইনাল দুবাইয়ে রেখে ‘হাইব্রিড মডেলে’ যেতে পাকিস্তানেরই-বা আপত্তি কোথায়?
ভারত তাদের দলকে পাকিস্তানে পাঠাবে না – এ খবর পাকাপাকিভাবে জানিয়ে দেওয়ার পর পাকিস্তানের একটা
টিভি শো-তে এ নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেখানে এক বক্তা জানালেন বিপ্লবী এক চিন্তা – ভারত যেহেতু পাকিস্তানে দল পাঠাতেই রাজি নয়, পাকিস্তানের উচিত ভারতকে বাদ দিয়ে তাদের জায়গায় শ্রীলঙ্কাকে ঢুকিয়ে ৮ দলের এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের ব্যাপারে আইসিসিকে জোরারোপ করা। কিন্তু ওই শো-তেই থাকা আরেক আলোচনা পাল্টা উত্তরে বললেন, ‘ব্যাট আর বল যার, তাকেই তো আর আপনি খেলা থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন না! পুরো ক্রিকেট বিশ্বই যাদের ওপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে এই টুর্নামেন্টের সম্প্রচারক প্রতিষ্ঠানই যে দেশের, সেই ভারতকে তো বাদ দেওয়া যায় না!’
এই বিতর্কই ভারতের দিক থেকে পাকিস্তানে দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ভবিষ্যৎ নিয়ে যত প্রশ্নের মূল কথা। ভারত তাদের সিদ্ধান্তে অনড়, অহমে আঘাত পাওয়া পাকিস্তানও ‘হাইব্রিড মডেলে’ আয়োজনে না যেতে সব চেষ্টা করছে, আইসিসি পড়েছে গ্যাঁড়াকলে।
এশিয়া কাপ একে তো শুধু এশিয়ার টুর্নামেন্ট, তারওপর বছরখানেক আগে সেটিতেও তারা আয়োজক থাকলেও পাকিস্তান মূলত সেখানে কাগজে-কলমেই আয়োজক ছিল। সর্বশেষ কোনো বৈশ্বিক আসরের আয়োজন পাকিস্তানের মাটি দেখেছে ১৯৯৬ সালে, যখন ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মিলে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল তারা। প্রায় তিন দশক পেরিয়ে যাচ্ছে সে আয়োজনের, আরেকটি বৈশ্বিক আয়োজনের সুযোগে তাই কোনোভাবেই কাউকে ভাগ দিতে চায় না পাকিস্তান।
তাদের মাটি ঘিরে নিরাপত্তাশঙ্কাও যে অমূলক, সেটা দেখিয়ে দেওয়ার ব্যাপারও তো এখানে বড় একটা ফ্যাক্টর। পাকিস্তান ‘অনিরাপদ’ – এই ধারণাটাই বদলে দিতে চায় দেশটা। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো একটা টুর্নামেন্টের সফল আয়োজন করতে পারলে ধারণাটা বদলে দেওয়ার পথে বড় একটা ধাপ পেরোবে পাকিস্তান।
কিন্তু ভারত না গেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আয়োজনই-বা কীভাবে হবে? তাছাড়া যাদের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক রেষারেষি, সেই ভারতকে নিজ দেশে এনে টুর্নামেন্ট নিরাপদে আয়োজন করতে পারলেই না পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটানো যাবে ভালোভাবে! ভারতকে বাদ দিয়েই টুর্নামেন্ট পুরোটা পাকিস্তানে হলেও তা-ও কিছুটা মুখ বাঁচে, কিন্তু ভারতের ম্যাচ অন্য দেশে রেখে পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আয়োজন তো আর পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন মুছে দেবে না। উল্টো প্রশ্নগুলো বড় হয়েই দেখা দেবে। সেখানেই প্রশ্ন – ভারতকে ছাড়া কি টুর্নামেন্ট আদৌ সম্ভব? ক্রিকেটের বৈশ্বিক চিত্র তো তা বলে না।
ভারতের পাকিস্তানে দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত আর পাকিস্তানের ‘হাইব্রিড মডেলে’ না যেতে অনড় থাকা – দুইয়ে মিলে এখন তিনটা বিকল্প সামনে দেখা দিচ্ছে –
১. পিসিবি কোনোভাবে হাইব্রিড মডেলে রাজি হলো, টুর্নামেন্টের ১৫ ম্যাচের মধ্যে ভারতের ম্যাচগুলো আর সেমিফাইনাল-ফাইনাল মিলিয়ে ৫টি ম্যাচ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আয়োজন।
২. পুরো টুর্নামেন্টই পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, যেটা হলে আবার পাকিস্তান টুর্নামেন্টে না খেলার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
৩. চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আয়োজনই অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া।
তিনটি বিকল্পই পিসিবি আর আইসিসির মাথাব্যথা বাড়াবে বৈ কমাবে না। কারণ যা-ই হোক, পাকিস্তান টুর্নামেন্ট থেকে সরে গেলে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে, এমনকি আইসিসির তহবিলও না পাওয়ার শঙ্কায় পড়বে। যদিও সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তি থাকবে – ঝামেলা তো ভারত পাকিয়েছে, বাকি সব দল রাজি হলেও শুধু তারাই পাকিস্তানে দল পাঠাতে চায়নি। নিষিদ্ধ করলে তো তাদের করা উচিত।
টুর্নামেন্ট পাকিস্তান থেকে সরে গেলে অন্তত ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ‘আয়োজন ফি’ পাবে না পাকিস্তান, অঙ্কটা যে কোনো বোর্ডের জন্যই বিশাল, অর্থের দিক থেকে ভারত-ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা পিসিবির জন্য এমন পরিমান অর্থ হাতছাড়া হওয়া আরও বড় ধাক্কা। তাছাড়া টুর্নামেন্ট সরে গেলে পাকিস্তানের তো আরও ক্ষতি আছে – টুর্নামেন্টের জন্য করাচি, রাওয়ালপিন্ডি আর লাহোরের স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজে কোটি কোটি রূপি ব্যয় হয়েছে না!
পাকিস্তান থেকে যত প্রতিবেদন এসেছে এখন পর্যন্ত, সবগুলোর সুর একই – পাকিস্তানের সরকার পিসিবিকে বলে দিয়েছে, হাইব্রিড মডেলে যাওয়া যাবে না। ‘এ নিয়ে আলোচনার সুযোগই নেই। পিসিবি স্বাভাবিকভাবেই সরকারের নির্দেশনা মেনে চলবে – পুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনকে উদ্ধৃত করে লিখেছে ক্রিকবাজ।
গত কদিনে এই অচলাবস্থার পর আইসিসির কাছে লিখিতভাবে পূর্ণ ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছে পিসিবি। ভারতের অবস্থান জানানোর পর আইসিসির সঙ্গে পিসিবির যত কথা হয়েছে, সেখানে ভারতের দিক থেকে ‘নিরাপত্তাশঙ্কা’কে কারণ দেখানো হয়নি বলেই লিখেছে ক্রিকবাজ। সে কারণেই পিসিবি অনেক প্রশ্ন তুলছে। পাশাপাশি পিসিবি এটাও জানিয়ে রেখেছে যে, গত দুই বছরে পাকিস্তানে গিয়ে নিউজিল্যান্ড তিনবার খেলেছে, ইংল্যান্ড দুবার, অস্ট্রেলিয়া একবার। ইঙ্গিতটা এই, তাহলে ভারতের সমস্যা কোথায়!
তবে আইসিসি এখন এমনই ঝামেলায় পড়েছে যে, কী করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে তারা একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যেটা নিয়ে পাকিস্তানের গোস্সা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। গতকাল টুর্নামেন্টের ঠিক ১০০ দিন আগে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সূচি ঘোষণার পাশাপাশি ‘হানড্রেড ডে কাউন্টডাউন’-এর অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল লাহোরে, সেটি আইসিসির নির্দেশনায় বাতিল করা হয়েছে। জল আরও ঘোলা হলো এতে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় আইসিসির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনে অহমের যুদ্ধে নামা ভারত যে পাকিস্তানে তাদের দল পাঠাবে না, সেটা তো আগে থেকেই অনুমিত ছিল। ক্রিকবাজের প্রতিবেদনে লেখা, টুর্নামেন্টের সময়সূচি কী হতে পারে, সে ব্যাপারে সব বোর্ডকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিসিসিআই তখন কিছু বলেনি। সময়সূচির ধারণা দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১২টি বোর্ড মিটিং হয়েছে আইসিসিতে, তখনো বিসিসিআইয়ের দিক থেকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারতের অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠেনি।
প্রসঙ্গত, বিসিসিআইয়ের সম্মানসূচক সচিবের পদে থাকা জয় শাহ আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে আইসিসির চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন। জয় শাহর আরেকটি পরিচয়, তিনি ভারতের মূখ্যমন্ত্রী অমিত শাহ-র ছেলে।
বিসিসিআই বারেবারেই বলে এসেছে, তারা ভারতের সরকারের নির্দেশনা মেনে কাজ করবে। ভারতের সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর অনেক আগে থেকেই বলে এসেছেন যে তাঁরা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্তানে দল পাঠাবেন না। সে সময়ে সেটি বিসিসিআইয়ের আনুষ্ঠানিক বার্তা হয়তো ছিল না, তবে ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতার বিন্দুমাত্রও খোঁজ রাখা যে কেউই জানতেন, এটাই হতে যাচ্ছে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান। তা-ই হয়েছে। জটিলতা এখন বেড়েছে।
বল এখন পুরোটাই আইসিসির কোর্টে। বলটাতে ‘সুইং’ কি ভারতের ইচ্ছায়ই হবে কি না, সেটাই যা দেখার।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ