টানা ও ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলা প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, কুড়িগ্রাম এলাকার নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। প্লাবিত হওয়ায় এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় আছে।
গত ১৫ দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ছয় উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, গত বছর ভেঙে যাওয়া দোয়ারাবাজার উপজেলার খাসিয়ামারা বেড়িবাঁধের সংস্কার না করায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবার বেড়েছে।
গত ১৫ দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে মেনে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদীর পানি বাড়তে শুরুর করায় হাওরের পানি বাড়ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ছয়টি উপজেলা দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুরের দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার সড়ক যোগাযোগ এখন বন্ধ আছে।
পানিবন্দী হয়ে পড়ায় এসব এলাকার মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় গরু, বাছুরসহ গৃহপালিত পশু নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকার বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মাছ চাষের পুকুরগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
সুরমা ইউনিয়নের জিয়ারপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ বলেন, খাসিয়ামারা নদীর ভাঙা বাঁধের কারণে পাহাড়ি ঢলের পানি এলাকায় ঢুকে শতাধিক পুকুর তলিয়ে দেয়। ফলে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। তিনি আরো জানান, ‘অনেক মানুষ ঋণ করে পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন। পুকুরের সব মাছ ভেসে যাওয়ায় অনেক মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, দোয়ারাবাজারের খাসিয়ামারা বাঁধ পরিচালনা কমিটির দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় গত বছর ভাঙলেও এ বছরও তা সংস্কার করা হয়নি। তাই পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই প্লাবিত হয়েছে ওই এলাকা।
খাসিয়ামারা রাবার ড্যাম পরিচালনা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিনোদ পুরকায়স্থ বলেন, ‘২০০৪ সালে রাবার ড্যামের বাঁধটি নির্মাণ করার সময় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নকশায় ভুল ছিল। নদীতে রাবার ব্যাগটি ছোট হওয়ায় ও নদীর নাব্যতা কম হওয়ায় ঢলের সময় পানি রাবারে আটকে বাঁধটি ভেঙে যায়। আর এই ভাঙন দিয়ে ঢলের প্রথম থাক্কাতেই এসব এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। কমিটির মধ্যে দুই দলের দ্বন্দ্ব থাকায় গত বছর বাঁধটি ভাঙলেও পুনরায় সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।’
দোয়ারাবাজারের বাসিন্দা ইউসুফ মিয়া (তুকু মিয়া) বলেন, ‘গত বছর বাঁধটি ভেঙে গেলেও আর সংস্কার হয়নি। আর আগামী বছরও সংস্কার হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পাহাড়ি ঢলে এলাকায় কোমর পরিমাণ পানি থাকে। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। খাবার নাই, পানি নাই। কেউ এসে দেখেও না।’
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, ‘রাবার ড্যাম পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বের কারণে সংস্কারকাজ সম্ভব হয়নি। কিছুদিন আগে রাবার ড্যাম পরিচালনা কমিটির বিবদমান দুটি পক্ষসহ দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমাকে নিয়ে বিষয়টির মিটমাট করেছেন। আমরা আশা করছি এ মৌসুমে সংস্কারকাজ সম্পন্ন হবে।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক বলেন, ‘উপজেলার ছয়টি ই্উনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিলেও কবে চাল এসে পৌঁছাবে তা এখনো জানি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এসব অসহায় মানুষের জন্য শুকনা খাবার বেশি প্রয়োজন। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া এ চাল এই এলাকার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, পানি নেমে গেলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বেশি প্রয়োজন হবে। তাই তিনি প্রশাসনসহ সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান।
দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
সিলেটের চার উপজেলা প্লাবিত
বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সদর উপজেলাসহ চার উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলা ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এসব উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। পিয়াইন গাঙ্গ ও সারি গোয়াইন নদীর পানি তীব্র গতিতে ঢুকছে বিভিন্ন গ্রামে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। প্লাবনের কারণে ডুবে গেছে সিলেট-সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের একাধিক অংশ। তাই এ সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের বহু সড়ক তলিয়ে গেছে।
বন্যার কারণে জাফলংয়ে পাথর উত্তোলন ব্যাহত হচ্ছে। সিলেট জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট এ বন্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আরো অবনতি ঘটে, তা হলে দুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী প্রেরণের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের ১৬ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি
গত তিনদিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ৩০টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর প্লাবিত হয়ে পড়েছে। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা।
পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার দুই শতাধিক পুকুর ও মৎস্য চাষ প্রকল্পের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে ১০০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেতসহ আমন বীজতলা।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজার রহমান বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার, নুন খাওয়া পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য সরবরাহ করেছেন দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী, মঈনুল হোসেন বুলবুল, হাসিবুর রহমান হাসিব, মো. মোস্তফা আবিদ)