বিভিন্ন প্রচারণামূলক পদ্ধতি গ্রহণ এবং জন্ম সনদের সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পরও নারীদের ভোটার হতে আগ্রহী করে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যে কারণে আদমশুমারিতে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান হলেও ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ কমানো যাচ্ছে না। প্রতিবছরই পুরুষ ভোটারের সংখ্যা বাড়লেও আশঙ্কাজনক হারে কমছে নারী ভোটার। এতে করে ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের সামঞ্জস্যতা রাখার লক্ষ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না ইসির।
বিয়ের আগে মেয়েদের বয়স লুকানোর প্রবণতাকেই এর জন্য দায়ী করছেন ইসি সংশ্লিষ্টরা। তাই এখন থেকে বিয়ের ক্ষেত্রে জন্ম সনদের সঙ্গে বয়স প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবছে ইসি। ইতিমধ্যে এই ধরনের একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই কমিশন বৈঠক ডেকে এই প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হবে। এরপরই স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়ে তা অবহিত করা হবে। ইসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, নারী ভোটার কমে যাওয়ার নেপথ্য কারণ উদঘাটনে ইসির গঠিত তদন্ত কমিটি দেখতে পেয়েছে, দেশে ভোটারযোগ্য অনেক নারী বয়স লুকাতে ভোটার হন না। ভোটার হলে বয়সটি সমাজে জানাজানি হবে, এ ভয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার তাদের মেয়ে সন্তানদের ভোটার হওয়ার নিরুৎসাহিত করেন।
ইসির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, যে কোনো দিন কমিশন একটি সভা আহ্বান করতে পারে। ওই সভাতে চারটি এজেন্ডা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে; তার মধ্যে ‘বিবাহ নিবন্ধনে জন্ম সনদের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র’ নিশ্চিত করা একটি। বাকি এজেন্ডা হচ্ছে জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনের সাধারণ ছুটি বাতিল করা ইস্যুতে আলোচনা, সিটি করপোরেশন (ইলেক্ট্রনিক্স ভোটিং মেশিন) সংশোধন-২০১৫ এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের পার্সোনালাইজেশন প্রস্তাব অনুমোদন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, দিন দিন শহর-গ্রামাঞ্চলে পুরুষের তুলনায় নারীদের ভোটার হওয়ার প্রবণতা কমছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা শুরুর দিকে পুরোচিত্র ছিল উল্টো। সে সময় নারীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নিবন্ধন কেন্দ্রে এসে ছবি তুলে ভোটার হতেন বরং পুরুষরা এটাকে নানাভাবে অবহেলা করে নিজেদের দূরে রাখতেন। এখন পুরুষরা তাদের প্রয়োজনে ভোটার হলেও পিছিয়ে পড়ছেন নারীরা। এ নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন ইসি।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ভোটার হালনাগাদ তালিকার মতো এবারো কমেছে নারী ভোটার। সর্বশেষ ওই তালিকায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার ৭ লাখ ৪ হাজার জন কম। ৬৪টি জেলার মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও ভোলায় সবচেয়ে কম ছিল। এর আগে ২০০৮ সালে দেশের ভোটার সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮ জন। পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি ছিল ১৪ লাখ ১৩ হাজার। এরপর থেকে প্রতি বছরের হালনাগাদে নারী ভোটারের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। ২০১৩ সালে হালনাগাদ শেষে দেখা গেছে, নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৯১ হাজার বেশি।
ভোটার তালিকা দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, আদমশুমারি অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের সংখ্যা কাছাকাছি। যে কারণে ভোটার তালিকার এই ব্যবধান প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ উঠেছে, তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যাননি বলেই নারী ভোটার কমে গেছে। তবে কমিশন থেকে নতুন করে বাড়ি বাড়ি যেতে তথ্য সংগ্রহকারীদের নির্দেশ দিলেও নারী ভোটারের খোঁজ মেলেনি। তাই পিছিয়ে থাকা নারীদের ভোটার হতে উৎসাহিত করতে বিবাহের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে দেয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাবে ইসি। যাতে অচিরেই তাদের এই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা হয়।
এ বিষয়ে ভোটার তালিকা শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমানে বিবাহের ক্ষেত্রে জন্মসনদ বয়স নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একমাত্র দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। যা সহজেই মিলানো সম্ভব। কিন্তু ছবিসহ ভোটার পরিচয়পত্রটি প্রকৃত বয়স নির্ণয়ের অন্যতম মাপকাঠি যা নকলের সম্ভাবনা কম। এটা চালু হলে দরিদ্র পিতা-মাতা তাদের মেয়েকে বিবাহ দিতে ভোটার তালিকায় নাম উঠাবেন। এতে কমিশনের নারী ভোটার বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। অন্যদিকে অপ্রাপ্ত বয়সে নারীর বিবাহ বন্ধে ভূমিকা থাকবে।