৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিদ্রোহী ও মনোনীত প্রার্থীরা মুখোমুখি,বিপাকে আ.লীগ

সামনের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে ব্যাপক বিভক্তি তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে। মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের অভিযোগের পাহাড় জমেছে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে।স্থানীয় সাংসদ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতারা এখন একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে।

এ অবস্থায় প্রতিটি ইউনিয়নে চার থেকে পাঁচজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
বঞ্চিতদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য জেলাভিত্তিক ফাইল তৈরি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে । এ পর্যন্ত তিন শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে বলে দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা জানিয়েছেন। এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কেউ কেউ বলেছেন, দলের মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধিতাকারী পরিবারের সন্তান। অনেকের অভিযোগ, বিএনপি-জামায়াত থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারীরা মনোনয়ন পেয়েছেন। কারও কারও অভিযোগ, দলীয় প্রার্থী ভূমিদস্যু, হত্যা মামলার আসামি ও দুর্নীতিতে জড়িত। সক্রিয় ও জনপ্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নিষ্ক্রিয় ও অজনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় মনোনয়নবঞ্চিত এক প্রার্থীর সমর্থকেরা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। কয়েক দিন ধরে সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় মনোনয়নের বিরোধিতা হয়েছে কয়েকটি জেলা-উপজেলায়।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণের জন্য দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এস এম কামাল হোসেনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। গতকাল রাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মনোনয়ন বোর্ড প্রথম পর্বের সব চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। ইতিমধ্যে গতকাল সকাল থেকে দলীয় প্রধানের সই করা চিঠি বিতরণ শুরু হয়েছে।
মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠা প্রসঙ্গে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আমি বলতে চাই না, কোনো অভিযোগ পেলে পরিবর্তন করব না।’

প্রথম দফায় দেশের ৭৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে, এর বেশির ভাগই উপকূলীয় জেলাগুলোতে। সবচেয়ে বেশি খুলনা ও বরিশাল বিভাগে।
কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, ইউপি নির্বাচন ঘিরে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে খুলনা জেলায়। এই জেলায় ৭০টি ইউনিয়নের নির্বাচন হচ্ছে। জেলা সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক হারুনুর রশিদ এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার মধ্যে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল। ইউপি নির্বাচন ঘিরে তাঁদের দ্বন্দ্ব বেড়েছে।
ওই নেতাদের মতে, মোস্তফা রশিদীর প্রভাব বেশি। তাই অধিকাংশ ইউনিয়নের প্রার্থীই তাঁর পছন্দের। ফলে কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন থেকে যে তালিকা তৈরি করা হয়, তাতে সই না করে আলাদা তালিকা পাঠান সভাপতি হারুন। তবে কেন্দ্র যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁদের প্রায় সবই মোস্তফা রশিদীর তালিকার। গতকাল জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিনভর ধানমন্ডি কার্যালয়ে অবস্থান করে নিজ নিজ প্রার্থীকে চূড়ান্ত করার চেষ্টা করেন।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৫ নম্বর আটলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ কুমার রায় লিখিত অভিযোগ করেন, তাঁর ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম, যাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। গত মঙ্গলবার খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতাপ আরও অভিযোগ করেন, মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। ৫ নম্বর আটলিয়া ইউনিয়নের মনোনয়ন বদলের দাবি জানিয়ে ধানমন্ডি কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছে খুলনার চুকনগর গণহত্যা ’৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ।
বাগেরহাটের ১৫ নম্বর মোরেলগঞ্জ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অভিযোগ করেন, ওই ইউনিয়নে মনোনয়ন পাওয়া মাহমুদ আলী হাওলাদার একাত্তরের শান্তি কমিটির সদস্যের ছেলে।
খুলনার তেরখাদার উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দলীয় প্যাডে অভিযোগ করেছেন, উপজেলার ৪ নম্বর সাচিয়াদহ ইউনিয়নে মনোনয়ন পাওয়া এ বি এম আলমগীর শিকদার যুবলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি এবং বিএনপি ঘরানার লোক।
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের সাকতা ইউনিয়নের মনোনয়নপ্রত্যাশী জসিম উদ্দিন চিঠি দিয়ে দাবি করেন, দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সালাউদ্দিন লিটন ভূমিদস্যু ও চাঁদাবাজ। তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় দৈনিকে ছাপা হওয়া সংবাদের কপিও জুড়ে দেওয়া হয়।
কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার ১ নম্বর উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে সরওয়ার আলম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি করে চিঠি দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দেওয়া ইয়াহিয়া খান কুতুবী। তিনি দাবি করেন, সরওয়ার জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদের আত্মীয় এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরওয়ার আলম জামায়াত প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। আযাদের সঙ্গে মিছিলের ছবিও অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।

কক্সবাজার জেলার ১৯টি ইউনিয়নে প্রথম পর্বে নির্বাচন হচ্ছে। জেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠক করে বর্তমান চেয়ারম্যান এনামুল হক চৌধুরী ছাড়া অন্য যে কাউকে প্রার্থী করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এনামুল হককেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ উল্লাহসহ আরও কয়েকজন প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মহেশখালী কালারমারছড়া ইউনিয়নে তৃণমূলের প্রস্তাব ছিল তারেক বিন ওছমান শরীফকে প্রার্থী করার। কিন্তু দেওয়া হয়েছে তারেকের পিতার হত্যা মামলার আসামি সেলিম চৌধুরীকে। সে কারণে মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারেক।
পটুয়াখালীর বাউফলে ১১টি ইউনিয়নের যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সবাই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের লোক বলে পরিচিত। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর মেয়র জিয়াউল হকসহ স্থানীয় একটা পক্ষ ১১টি ইউনিয়নেরই আলাদা প্রার্থী তালিকা পাঠায় কেন্দ্রে। কিন্তু কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড ফিরোজের লোকদেরই মনোনয়ন দেয়। এখন জিয়াউল হক সমর্থকেরা প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জিয়াউল হকের অভিযোগ, মনোনয়ন পাওয়াদের মধ্যে দুজনের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির দলনেতা ছিলেন। তাছাড়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভূমি দখল, হত্যাসহ নানা অভিযোগ আছে।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে পূজা উদ্যাপন পরিষদ। পূজা উদ্যাপন পরিষদের সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পরিষদ সভাপতি সনৎ কুমার বলেন, তৃণমূলের ভোটে ধলবাড়িয়া ইউনিয়নে সজল মুখার্জি এবং দক্ষিণ শ্রীপুরে গোবিন্দ মণ্ডল জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মনোনয়ন পাননি। এমনকি ধলবাড়িয়ায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতার বিপক্ষের লোক গাজী শওকত হোসেনকে। এ জন্য গতকাল তাঁরা সভা করে ১২ ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এবার নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামীলীগের প্রার্থীদের বেশ তোড়জোড় চলছে। কেন্দ্রীয় ভাবে বেশ কঠোর নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তবে প্রার্থী নিয়ে মতবিরোধে নেতা কর্মীদের মধ্যে কিছুটা বিভক্তি দেখা গেলেও নিরবাচনের কাজ চলছে পুরোদ্দমে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ