৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায় ব্যবসায়ীরা

বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই দেশে। চাহিদা অনুযায়ী জমিও পাওয়া যায় না। তার ওপর রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এমন পরিবেশে এখানে বিনিয়োগের সুযোগ নেই দাবি করে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি চান ব্যবসায়ীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা করা দরকার।

বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে গতকাল রাজধানীতে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি)। সভায় ব্যবসায়ীদের সংগঠনটির পক্ষ থেকে ‘পলিসি গাইড লাইনস অন ওভারসিজ ইনভেস্টমেন্ট বাই বাংলাদেশী এন্ট্রাপ্রেনিউরস’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করা হয়, যেখানে বিদেশে বিনিয়োগের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।

আইবিএফবির সভাপতি হাফিজুর রহমান খানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।

অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইবিএফবির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, আইবিএফবির সহসভাপতি হুমায়ুন রশিদ, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, প্রথম আলোর বিজনেস এডিটর শওকত হোসেন মাসুম, ইত্তেফাকের বিজনেস এডিটর জামাল উদ্দীন, ডেইলি সানের বিজনেস এডিটর গোলাম শাহনী প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইসমাঈল হোসেন। এতে বলা হয়, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সময় এসেছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বিদেশে বিনিয়োগ করলে শুধু অর্থ চলে যাবে, এটা ভাবা ঠিক নয়। কারণ এর মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে ফেরতও আসবে।

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) রেফারেন্স দিয়ে এতে বলা হয়, ২০০২ থেকে ২০১২— এ ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ১২ বিলিয়ন ডলার চলে গেছে। ২০১৪ সালে মূলধন পাচার হয়েছে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হলে এ অর্থ বৈধ পথেই যেত। ভারত, মিয়ানমার, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের অবারিত সুযোগের কথাও তুলে ধরা হয় এ নিবন্ধে।

তবে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার আগে আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা (কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ) রয়েছে, সে বিষয়গুলো বিবেচনা করে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারেন। বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার বিরোধিতা করছি না, তবে সেক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে।

তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এর পরও কিছু অনিশ্চয়তার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগকারী আসছেন না। অনিশ্চয়তাগুলো দূর করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বস্ত্র শিল্পকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। তাছাড়া দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তা করা হলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। তখন আর বিনিয়োগ করতে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। তবে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস, বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজন। বিশ্বের কোথাও গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় না। বরং গ্যাস শুধু শিল্পে দেয়া হয়। বিষয়টি সরকারের ভাবা প্রয়োজন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ব্যবসায়ী এ কে আজাদ বলেন, বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আমরা তা পাচ্ছি না। সরকার বলছে, আগামী ১৫ বছর পর গ্যাসের সরবরাহ কমে যাবে। তখন এলএনজির মাধ্যমে চাহিদা মেটানো হবে। কিন্তু এলএনজির জন্য সে ধরনের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে আমরা কীভাবে কারখানা চালাব? সরকারের দীর্ঘমেয়াদি কোনো জ্বালানি নীতিমালাও নেই। কয়লা নীতিমালা নেই। কারখানায় জ্বালানির সরবরাহ নিয়ে আমরা এক ধরনের অন্ধকারের মধ্যে আছি। এ পরিবেশে আমরা কীসের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করব? তার মধ্যে কিছুদিন পর পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশই সহজ শর্তে জমি ও জ্বালানি দিতে প্রস্তুত। সুতরাং আমাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হোক।

আইবিএফবির সভাপতি হাফিজুর রহমান খাঁন বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ চেয়ে উদ্যোক্তাদের মতামত সরকারের নীতিনির্ধারকদের নজরে আনা হবে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায় পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এ কারণে বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে দেশের ইমেজ সংকট কাটানো সহজ হবে বলে মনে করেন আইবিএফবির সদস্য মাইনুদ্দীন চৌধুরী। তিনি বলেন, তবে এ সুযোগ অবারিত করে দেয়া ঠিক হবে না। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য উৎপাদনে এ সুযোগ থাকা উচিত।

সভায় প্রথম আলোর বিজনেস এডিটর শওকত হোসেন মাসুম বলেন, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থাকার পরও দেশে বেসরকারি খাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ হচ্ছে না। অথচ এ অর্থ উদ্যোক্তারা কেন দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চান, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

ইত্তেফাকের বিজনেস এডিটর জামাল উদ্দীন বলেন, উদ্যোক্তাদের সুবিধা বিবেচনায় বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার সময় এসেছে। তবে বাংলাদেশই যেখানে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে চেষ্টা করছে, সেখানে আমাদের উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা ভাবা উচিত।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ