মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,
প্রায় সময় পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই, দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। আসুন আজ জানার চেষ্টা করি বজ্রপাত কেন কিভাবে এর সৃষ্টি হয়।
বজ্রপাত কি ?
বায়ুমন্ডলের উপরের অংশে নীচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকে। এ কারনে অনেক সময় দেখা যায় যে, নীচের দিক থেকে উপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়। এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড (Thunder Clouds) বলে। অন্যান্য মেঘের মত এ মেঘেও ছোট ছোট পানির কনা থাকে। আর উপরে উঠতে উঠতে পানির পরিমান বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে পানির পরিমান যখন ৫ মিঃমিঃ এর বেশী হয়, তখন পানির অণুগুলো আর পারস্পারিক বন্ধন ধরে রাখতে পাড়ে না। তখন এরা আলাদা (Disintegrate) হয়ে যায়। ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের (Electric Charge) এর সৃষ্টি হয়। আর এ আধানের মান নিচের অংশের চেয়ে বেশী হয়। এরকম বিভব পার্থক্যের (Potential difference) কারনেই ওপর হতে নিচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন (Transmission) হয়। এ সময় আমরা আলোর ঝলকানি (Lightning) দেখতে পাই।
আর ক্রিয়ার সময় উক্ত এলাকার বাতাসের প্রসারন (Expansion) এবং সংকোচনের (Contraction) ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে।
কখন কিভাবে সৃষ্টি হয় ?
মার্চ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিহারের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তখন বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাস্প পূর্ন বায়ু প্রবাহ এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এই ছুটে আসা আদ্র বায়ু প্রবাহ এই দুয়ের সংঘাতে একটি দুটি করে বজ্র মেঘের সৃষ্ট হয়। আর সেগুলি তীব্র গতিতে মাথা তুলতে থাকে। এই মেঘগুলি থেকে নিঃসৃত শীতল ঝড়ের জাপটা (Cold down draft) সামনের দিকে আঘাত করে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ুস্তর ঐ ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে ওপরে উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গায় নতুন করে বজ্র-মেঘ সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে প্রথম যে একটি দুটি মেঘ তৈরী হয়েছিল তাদেরকে জননী (Mother Thunder Storm) বলা হয়। তবে সামনের দিকে সৃষ্ট হওয়া নতুন বজ্র-মেঘ গুলো কে বলা হয় কন্যা (Daughter Thunder Storm)। এই ভাবে সামনের দিকে ক্রমে অনেক গুলি বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়ে একটা রেখা বরাবর দক্ষিন-পূর্ব দিকে এগোয়।
রাডার যন্ত্রে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় যে, কালবৈশাখী মেঘের এই রেখাটি (Line Squacl Cloud) ক্রমে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিন-পূর্বে এগিয়ে যায়। এই রেখার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ১০০ কিঃমিঃ পর্যন্ত হয়।আর বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০কিলোমিটারের মত হয়। এই রেখাটি যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে ঝাপটা দিয়ে যায়, সেই অঞ্চলেই কালবৈশাখীর তান্ডবলীলা চলে। ক্রমে ক্রমে এই মেঘ বঙ্গোপসাগরের কাছে পড়লেই এই কাল কালবৈশাখী ঝড় নিস্তেজ হয়ে যায়। কারন সমুদ্রের ওপর কালবৈশাখী হয় না। মনে রাখতে হবে যে কালবৈশাখী মেঘের বিস্তৃতি হয় প্রায় ১৫- ২০ কিঃমিঃ এর মতো। মেঘগুলি সাধারনত প্রতি ঘন্টায় ২৫-৩০ কিঃমি গতিতে এগোয়। সুতরাং কোন স্থান অতিক্রম করতে এই মেঘগুলির সাধারনত আধঘন্টা থেকে বড়জোর এক ঘন্টার মতো সময় লাগে। বৃষ্টি ও ততক্ষন হয়। কিন্তু বজ্র মেঘের সঙ্গে অনেক সময় মধ্যস্তর মেঘ থেকেও অনেক সময় বৃষ্টি হয়। এই জন্য কোন কোন সময়ে এক ঘন্টারও বেশী সময় বৃস্টি হতে পারে।
পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও ১০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে, অতএব সাবধান। বজ্র সৃষ্টি হয়ে তা পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ার প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল বলে জানান ড. সমন্দ্রে কর্মকার। বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাও খুবই কঠিন। তবে সতর্ক হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে বলে তিনি জানান। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশের আগ মুহূর্তে ঘন কালো মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে। গুরগুর মেঘের ডাক শুনলেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল
১. বজ্রপাতের সময় কোন খোলা মাঠে বা খোলা স্থানে দাঁড়াবেন না, যদি ঐ স্থানে কোন বড় গাছ না থাকে, তবে আপনি সেই স্থানের সব থেকে উচু ব্যাক্তি। সেই সাথে কোন গাছের নীচে আশ্রয় নিবেন না। গাছের উপর বজ্রপাত বেশী হয়।
২. পানির কাছে থাকবেন না, রাস্তায় সাইকেল বা মটরসাইকেলের উপর থাকলে, দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহন করুন।
৩. যদি খোলা মাঠ বা খোলা জমিতে থাকেন, তবে লক্ষ্য করুন তার টানা কোন বৈদুত্যক খুঁটি আছে কিনা। যদি থাকে তবে দুই খুঁটির মাঝখানে তারের নিচে পায়ের পাতা উচু করে পাতার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকুন।
৪. বজ্রাহত কোন ব্যাক্তিকে কখনো খালি হাতে স্পর্শ করবেন না, কারন তার শরিরে তখনও বিদ্যুৎ থাকতে পারে।
৫. পাকা বাড়িতে আশ্রয় বেশি নিরাপদ। গাড়ির ভিতরও আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। গাছের নিচে, টেলিফোনের খুঁটির পাশে বা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের খাম্বার পাশে দাঁড়ানো মোটেই নিরাপদ নয়।
৬. পানির সংস্পর্শে মোটেই যাওয়া যাবে না। বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার আগেই তা মাটি স্পর্শ করে। সোজাসুজি মানুষের গায়ে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করাও বিপজ্জনক। শুকনা কাঠ দিয়ে ধাক্কা দিতে হবে।
৭. বজ্রপাতের সম্ভাবনা আবহাওয়া বিভাগের রাডারে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নাউকাস্টনিং’ পদ্ধতিতে মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ স্থানে যেতে পারে। এতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।
৮. কোনো কর্ডযুক্ত ফোন ব্যবহার করবেন না। মাটির সঙ্গে সংয্ক্তু ধাতব পদার্থে হাত বা হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন না। বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত পানির ফোয়ারায় গোসল করবেন না। মরা কিংবা পচন ধরা গাছ ও খুঁটি কেটে ফেলুন।
৯. বাসা, অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হলে বিদ্যুৎ সব সুইচ বন্ধ রাখুন, দরজা-জানালা ভালোমতো বন্ধ রাখুন। এ সময় সর্তক করার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাস আমাদের দেশে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা বেশি থাকে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
লামা (বান্দরবান)