সরকারের পাওনা নিয়মিত পরিশোধ করছে না টেলিযোগাযোগ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান। বকেয়া আদায়ে এরই মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টেলিযোগাযোগ আইন ও পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি (পিডিআর) আইনে মামলা করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। এর পরও নিয়মিত অর্থ পরিশোধ করছে না তারা। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পরিশোধ করছে না, এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ বিষয়ে বিটিআরসির সচিব ও মুখপাত্র সরওয়ার আলম বলেন, একাধিকবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও সরকারের পাওনা পরিশোধ করছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চূড়ান্ত তাগিদপত্র দেয়া হয়েছে। এর আগে বকেয়া আদায়ে পিডিআর আইনের আওতায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এবার এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ছয়টি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের (আইজিডব্লিউ) কাছে ৬৮৮ কোটি ৬৩ লাখ, পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) অপারেটরদের কাছে ৩৮ কোটি ৬৬ লাখ, সেলফোন অপারেটর সিটিসেলের কাছে ২৭৪ কোটি ৬৭ লাখ, ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (বিডব্লিউএ) অপারেটর বাংলালায়নের কাছে ৪৬ কোটি ৭২ লাখ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কাছে ১ হাজার ৬৪৫ কোটি ২৯ লাখ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটকের কাছে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের।
এরই মধ্যে ছয় আইজিডব্লিউর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এগুলো হলো— ভিশন টেল লিমিটেড, বেস্টেক টেলিকম লিমিটেড, টেলেক্স লিমিটেড, রাতুল টেলিকম, কে কমিউনিকেশনস ও এসএম কমিউনিকেশনস। পিডিআর আইন, ১৯১৩ ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। টেলেক্স লিমিটেড, রাতুল টেলিকম, কে কমিউনিকেশনস ও ভিশন টেল লিমিটেডের লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর শেষে বন্ধ এ ছয় প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের পাওনা ছিল ৫২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
দেশে আইজিডব্লিউ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯টি। এর মধ্যে কার্যক্রম চালু রয়েছে ২৩ প্রতিষ্ঠানের। ২০০৮ সালে নিলামের মাধ্যমে চার প্রতিষ্ঠানকে এ লাইসেন্স দেয়া হয়। আর ২০১২ সালের এপ্রিলে নতুন ২৫টি প্রতিষ্ঠান আইজিডব্লিউ লাইসেন্স পায়। প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় একসঙ্গে অনেকগুলো আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়ায় এ খাতে ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবসায়িক ঝুঁকির মুখে পড়ে।
দেশব্যাপী পিএসটিএন সেবাদানের লাইসেন্স পাওয়া পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে শুধু র্যাংকসটেলের সেবা। আর অঞ্চলভিত্তিক পিএসটিএনের মধ্যে চালু ছিল বাংলাফোন ও ওয়ার্ল্ডটেল। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ডটেলের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে লাইসেন্স পাওয়া ১৩ পিএসটিএনের মধ্যে বর্তমানে সেবা চালু আছে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের।
শুরুতে দেশের একমাত্র ফিক্সড ফোন অপারেটর ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল। ২০০৪ সালে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অঞ্চলভিত্তিক পিএসটিএন অপারেটর হিসেবে সেবা পরিচালনার অনুমতি দেয় বিটিআরসি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের শেষ দিকে দেশব্যাপী পিএসটিএন সেবাদানে লাইসেন্স দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বার্ষিক লাইসেন্স ফি, আয় ভাগাভাগির অংশ ও তরঙ্গ বরাদ্দ ফি হিসেবে ঢাকা টেলিফোনের কাছে সরকারের পাওনা রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া র্যাংকস টেলিকমের কাছে ৪ কোটি ২৩ লাখ, ন্যাশনাল টেলিকম ৪ কোটি ৩১ লাখ, টেলিবার্তা ১১ কোটি ৪৩ লাখ, পিপলসটেল ১ কোটি ৮৪ লাখ, ওয়ানটেল ২ কোটি ৬৮ লাখ, বাংলাফোন ২ কোটি ৭ লাখ, এসএ টেলিকম ২ কোটি ২৫ লাখ, ওয়েসটেক ১ কোটি ৬৬ লাখ, জালালাবাদ টেলিকম ২ কোটি ৮৩ লাখ, নেক্সটেল ৭৫ লাখ এবং ওয়ার্ল্ডটেলের কাছে ২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের।
সিটিসেলের কাছে তরঙ্গ বাবদ ২৪৬ কোটি ২৭ লাখ, রাজস্ব ভাগাভাগি বাবদ ১৬ কোটি ৪৭ লাখ, সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের ৬ কোটি ৯৩ লাখ ও লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের। একাধিকবার বকেয়া পরিশোধে সময় দেয়া হলেও তাতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এ বিষয়ে চূড়ান্ত তাগিদপত্রও দেয়া হয়েছে তাদের। তবে আবারো সময় চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করেছে সিটিসেল।
লাইসেন্স ও তরঙ্গ বরাদ্দ ফি এবং আয়ের ভাগাভাগির অংশ হিসেবে সরকারের প্রাপ্য অর্থ নিয়মিত পরিশোধ না করায় বিডব্লিউএ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলালায়ন কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের কাছে সরকারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বার্ষিক লাইসেন্স ফি বাবদ ৩ কোটি টাকা দেয়নি বাংলালায়ন। এছাড়া চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আয় ভাগাভাগির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ও তরঙ্গ বরাদ্দ ফি বাবদ আরো ৩৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের। পাওনা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিসও দেয়া হয়। গত বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে ছয়টি কিস্তিতে বকেয়া পরিশোধের সুযোগও দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর পরও নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। অর্থ পরিশোধে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে চূড়ান্ত তাগিদপত্রও দিয়েছে কমিশন।
এদিকে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল ও অভ্যন্তরীণ ফিক্সড ফোনসেবা থেকে আয়ের ভাগাভাগির অংশ এবং লাইসেন্স, তরঙ্গ বরাদ্দ ও বিলম্ব ফি বাবদ বিটিসিএলের কাছে সরকারের পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৬৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। মূলত প্রতিষ্ঠানটির পিএসটিএন, আইজিডব্লিউ ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্সের আওতায় পরিচালিত কার্যক্রমের বিপরীতে এ বকেয়া দাঁড়িয়েছে।
২০১২ সালের অক্টোবরে সরকার দেশের প্রথম সেলফোন অপারেটর হিসেবে টেলিটককে থ্রিজি প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সেবা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর অনুমোদন দেয়। তবে থ্রিজি সেবাদানে বরাদ্দ দেয়া ১০ মেগাহার্টজ তরঙ্গের মূল্য এখনো পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ বাবদ টেলিটকের কাছে পাওনা ১ হাজার ৫৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ অর্থ পরিশোধের সর্বশেষ সময় ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর। তবে একাধিকবার তাগাদা দিলেও তা পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বকেয়া পরিশোধে বিটিসিএল ও টেলিটককে ২১ দিনের সময় দিয়ে আবারো তাগিদপত্র দিয়েছে কমিশন।
প্রসঙ্গত, দেশে টেলিযোগাযোগ খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দুই হাজার বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।