মুশফিক হোসাইন
হরিতকি ফলের সাথে শৈশব থেকেই পরিচিত। বাবার ত্রিফলা সেবনের একটি অনুসঙ্গ ছিল হরিতকি। আমাদের দেশে দু’টি জাত দেখা যায়। অন্য প্রজাতির নাম বুনো হরিতকি, আঞ্চলিক ভাষায় বুনো হট্টই। বুনোটি আকারে বেশ ছোট এবং কালো, স্বাদ অতিকষ আর সাধারণ হরিতকি কমলা-বাদামি রঙের। তার গায়ে পাঁচটি কালো দাগ থাকে। ত্রিফলা অনুসঙ্গে এই প্রজাতি ব্যবহৃত হয়। তবে পান তামাক আসক্তি বর্জনে অনেকেই বুনোটি এস্তেমাল করেন। সিলেটে কর্মরত থাকাকালে জাফলং এর লেবু চেয়ারম্যানের সাথে তামাবিলস্থ তার খামারে গিয়েছিলাম। নো-ম্যান্স আইল্যান্ডের লাগোয়া খামার। এ পারে বিডি আর, ওপারে বিএসএফ। পাহাড়ে একটি উঁচু গাছ দেখিয়ে বললেন, স্যার এটা হরিতকি গাছ, ঔষধি বৃক্ষ। নাম বলার সাথে সাথে আমি চিনে ফেললাম, শৈশবের ফলটির বৃক্ষকে। যার নাম ও ফলের সাথে এতদিন পরিচিত ছিলাম। গাছে অনেক কাঁচা এবং পরিণত ফল আছে। আমি তাকে অনুরোধ করলাম কিছু ফল দেয়ার জন্য। কাঁচা ফলের রঙ সবুজ। তিনি বললেন, স্যার গাছের গোড়ায় পারেন বাত্তিফল (পাকাফল)। এই ফল পাড়তে হয় না, পরিপক্ক হলেই মাটিতে ঝরে পড়ে। খাশিয়াদের বিশ্বাস শিব দেবতার অভিশাপে হরিতকি পরিপক্ক হলে গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে। এখানে বলে রাখা ভালো, সবধরনের ফলই পাকলে আপনা-আপনি ঝরে পড়ে।
পরবর্তীতে সিলেটের নার্সারি থেকে একটি চারা এনে ছাদের টবে লাগিয়েছি। এখনো বেঁচে আছে। তবে ফুল ও ফল আসেনি। বয়স আনুমানিক ১০/১২ বছর। চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডিসি হিলের বাংলাদেশ নার্সারির সামনে একটি গাছে, গরীবুল্লাহ শাহ মাজার পেট্রোল পাম্পের দিকে একটি গাছে এবং হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি গাছে অজস্র ফুল এসেছে। ছবিতে যে ফুল, তা ডিসি হিল থেকে নেয়। এ গাছে গত বছরও বেশ ফল এসেছিল। আমি ২/১ টি কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। উপরে পাওয়া গাছগুলোর বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে হরিতকি ফুলের রঙ সাদা, বা হাল্কা হলুদ। ফুল অনেকটা বড়ই, জলপাই ফুলের মতো।
এর বৈজ্ঞানিক নাম, টারমেনালিয়া চেবুলা পরিবার কমব্রেটেসি, মধ্যম থেকে বৃহৎ আকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। পাতা গাঢ় সবুজ এবং লম্বাটে। বাকল গাঢ় বাদামী। বাকলে লম্বা ফাটল থাকে। কাঠের রঙ ঘন বেগুনি। কাঠ খুব শক্ত। মধ্যম আকারের টেকসই। ভালে পালিশ হয়। বর্গা আসবাবপত্র ও কৃষি যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য নানাকাজে ব্যবহার হয়। গাছের উচ্চতা ৯০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত। বাংলাদেশের সবত্রই পাওয়া যায়। গাছের চেয়ে মূল্যবান এর ফল। ফল থেকে ট্যানিন, লেখার কালি, রঙ পাওয়া যায়। ফল কোস্ট পরিস্কারক। ফলের গুঁড়া দাঁতের মাজন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদিক ওষধ ত্রিফলার একটি বিশেষ অনুপাত হরিতকি। ফল সংগ্রহের সময় জানুয়ারি মার্চ (পৌষ-চৈত্র) প্রতি কেজিতে ১৪০-২২৫টি বীজ হয়। ফল পাকার পর গাছ থেকে ঝরে পড়ে। গাছের তলা থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ বপনে অঙ্কুরোদমের হার অতি কম। শতকরা ৫০/৬০ ভাগ। বীজ থেকে চারা গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। জুন-জুলাই এ বীজ বপনের সময়। বীজ সরাসরি জমিতে বপন বা একবছর বয়েসি চারা তৈরি করে বর্ষাকালে জুলাই- আগস্টে চারা লাগাতে হয়। হরিতকির ফল সকলের পরিচিত হলেও এ বৃক্ষটি আমাদের পরিচিত নয়। আসুন আমরা বৃক্ষ চিনতে উদ্যোগী হয়। বৃক্ষ আমাদের বন্ধু।