[english_date]

নির্যাতিত-শোষিত মানুষের সংগ্রামী নেতা আবদুল লতিফ উকিল

এস.এম. জামাল উদ্দিন

আলহাজ্ব মরহুম আবদুল লতিফ উকিলের ইন্তেকালের সাথে সাথে একটি যুগের নয়, একটি আদর্শ ও এক অনন্য জীবন দর্শনেরও অবসান ঘটেছিল। এমন আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব, যে আত্মমর্যাদা এক অসাধারণ সংগ্রামের ফল, এ যুগে কদাচিৎ নজরে পড়ে। মেধা ও জ্ঞানের সঙ্গে দুর্দমনীয় সাহস, একনিষ্ঠ স্বদেশপ্রেম, জনদরদ ও দৃঢ় চিত্ততা তাঁর চরিত্রকে করে তুলেছিল এক শোভন মনোহারিত্বে অদ্বিতীয়।
ভারত বিভাগের পূর্বে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে, গরীব কৃষক-প্রজাকূলের উপর সামন্তবাদীদের শোষণ এবং জমিদারী-মহাজনী প্রথা উচ্ছেদের জন্যে মরহুম শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সহযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আলহাজ্ব মরহুম আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন অন্যতম। তিনি সামন্তবিরোধী আন্দোলনে পূর্বাঞ্চলীয় সংগঠক ছিলেন। কৃষক-প্রজা পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও ঋণ সালিশী বোর্ডের নেতা হিসেবে এই দায়িত্ব তিনি আরো বেশি যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেন।
১৯২৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে বিএল পাস করার পর তদানিন্তন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী মরহুম জালাল উদ্দিনের জুনিয়র হিসেবে বারে যোগদান করেন। বারে যোগদান করে তিনি দেখলেন যে, ব্রিটিশ শাসনে বাঙালি মুসলমানদের প্রতি পদে পদেই অনেক বাধা-বিঘœ, অনেক বিপদ। বিশেষতঃ রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তা প্রায় অত্যাচার-অবিচার-জুলুমে পরিণত হতে দেখা গিয়েছিল। তখন সাম্প্রদায়িকতার অর্থ করেছিল মুসলমান সমাজের উপকার ও স্বার্থরক্ষার চেষ্টাকে। আপোষহীন সংগ্রামী লতিফ উকিল এই অবস্থা দেখে নীরব থাকতে পারেননি। বাঙালি মুসলমানদেরকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সচেতন করে তুলতে এগিয়ে আসেন। গঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের চট্টগ্রাম শাখা (১৯২৪)।মরহুম কে.বি মকবুল হোসেন সভাপতি ও মরহুম আবদুল লতিফ উকিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর আগে কোন মুসলমান এই পদে নির্বাচিত হননি। পরে দীর্ঘদিন সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরও তিনি দেখতে পান যে, সামন্ত, সাম্প্রদায়িক ও ব্রিটিশের দালাল মনোভাবাপন্ন অবাঙালি ও গোঁড়া সামন্ত মনোভাবাপন্ন উকিলরা প্রতিবাদতী মুসলমান উকিলদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে সমগ্র বাংলায় (পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা) মুসলিম আইনজীবী সমিতি গড়ে তোলেন। এই সমিতি গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁকে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, ত্রিপুরার (বর্তমান কুমিল্লা) উকিল আবদুল করিম মিয়া ও নারায়ণগঞ্জের একজন সাহসী উকিল প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন।
মরহুম আবদুল লতিফ উকিল একজন সফল আইনজীবী ছিলেন। তিনি সবসময় তাঁর পেশার সম্মুখের আসনে ছিলেন। বহু মামলা তিনি বিনা ফিতে করেছেন। কোন মক্কেল মজলুম হলে তাকে সাহায্যও করেছেন। দল-মত-নির্বিশেষে রাজনৈতিক কর্মীদেরও সাহায্য করেছেন। দু:স্থ মানুষের হাতে অকাতরে তুলে দিয়েছেন তাঁর উপার্জিত অর্থ।
মরহুম উকিল সাহেব চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড সদস্য ও স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে শিক্ষা সম্প্রসারণে আলোকোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময়ে তাঁকে মরহুম সৈয়দ সোলতান, মরহুম আবদুর রহমান ও মরহুম আহমদ কবির চৌধুরী (সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ-আল-নোমানের পিতা) যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁরা সকলেই চেয়েছিলেন গ্রাম ভিত্তিক গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রামের কৃষক, দিন মজুরের সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষার নিশ্চয়তা পাবে। এই সময়ে মরহুম লতিফ উকিল সাহেবের কতিপয় ভক্ত তার নামে একটি স্কুল করার প্রস্তাব করলে তিনি কিছুতেই রাজী হননি এবং বলেছিলেন ‘দেশ ও জনগণের জন্যে আমি আল্লাহকে রাজী-খুশী করতে কাজ করছি, নিজের নামে জনপ্রতিষ্ঠানের নাম দেবার জন্যে নয়’। এই ধরনের শালীনতা, নিজের ও অপরের সম্বন্ধে পরিমিত জ্ঞান ও মূল্যবোধ মরহুম উকিল সাহেবের এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি হাটহাজারী হাই স্কুল ও কাজেম আলী হাই স্কুল পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। হাটহাজারী প্রাইমারী স্কুল ও ফটিকা রহমানিয়া প্রাইমারী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হযরত গরিব উল্ল্যাহ শাহ্ (রহ:), হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ:), হযরত মিসকিন শাহ্ (রহ:) দরগাহ কমিটির সেক্রেটারী, হাটহাজারী অদুদিয়া মাদ্রাসার সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ও হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার সূরা’র সদস্য ছিলেন।
১৯৪২ থেকে ৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কলেজের প্রশাসনিক ও বিজ্ঞান ভবন ছাড়া সৈন্যরা কলেজের অন্যান্য ভবন অবস্থানের জন্যে দখল করে নিলে ছাত্রদের ক্লাস করা ও আবাসিক সমস্যা দেখা দেয়। সেই সময় মরহুম আবদুল লতিফ উকিল চট্টগ্রাম কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য ও গুলজার বেগম স্কুলের সেক্রেটারী থাকায় তিনি গুলজার বেগম স্কুলে ক্যাপ্টেন মরহুম বখতেয়ারের সহযোগিতায় ক্লাস চালানোর এবং চন্দনপুরাস্থ তাঁর (মরহুম উকিল সাহেবের) বাসায় ও এলাকায় হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন পদ্মনি ভূষণ রুদ্র।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর মরহুম আবদুল লতিফ উকিল বুঝতে পারলেন যে, আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত। কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকচক্র পাকিস্তানকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। সেই সময়ে মরহুম উকিল সাহেব একটি শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী’র অনুরোধে তিনি তাতে যোগদান করেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ বৃহত্তর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন-সাধারণ সম্পাদক ছিলেণ মরহুম আবদুল আজিজ (জননেতা মরহুম এম.এ. আজিজ)। এই সালেই ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এই জনসভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন সরকার সমর্থিত গু-ারা সভায় হামলা চালালে বহুবিরোধী দলীয় কর্মী আহত হন এবং সভার সভাপতি আবদুল লতিফ উকিলের মাথা ফেটে রক্ত ঝরে। আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগ্রামী ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম রক্তপাত। পরিতাপের বিষয় ছিল, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী লীগের প্রধান ভূমিকা থাকলেও নির্বাচনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল লতিফ উকিলের স্থলে নেজামে ইসলাম পার্টির অধ্যাপক সুলতানুল আলম চৌধুরীকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এম.এ. আজিজের স্থলে কৃষক-প্রজা পার্টির মাহ্মুদুন্নবী চৌধুরীকে নমিনেশন দিয়ে ত্যাগী নেতাদের অমর্যাদা করা হয়। কথিত ঐক্যের জন্য বলি দেয়া হয়। অবশ্য পরবর্তীতে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি হবার পর ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন এবং সেভাবেই ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ ও প্রদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেন। কথিত ঐক্যের জন্য বলি দেওয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতার পরিবারের যোগ্য ব্যক্তিরা অভিমানে দূরে সরে যান। বর্তমান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও ত্যাগী-নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের মর্যাদা দিয়ে আসছেন- কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। ১৯৯৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় সত্ত্বেও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সরকারী দল বিএনপি’র শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে তিনবার মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নমিনেশন দেয়নি। অবশ্য তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আবদুল লতিফ উকিল ১৯৫৭ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজনীতি করার শারীরিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতারা চট্টগ্রাম আসলে আবদুল লতিফ উকিলের সাথে দেখা করতেন। কোন কারণে যদি আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাধ দেখা দিত বা সম্পর্কের অবনতি ঘটত তাহলে আবদুল লতিফ উকিল ইনসাফের সাথে ফয়সালা করে দিতেন যেন পরিবারগুলোর সম্পর্ক অটুট থাকে।
জননেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, মরহুম আবুল খায়ের সিদ্দিকী প্রমুখ আবদুল লতিফ উকিলের স্নেহভাজন ছিলেন এবং ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে এক সাথে রাজনীতি করেছিলেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ছিলেণ আপোষহীন ও নিঃঝনযাট। কোন্দলের রাজনীতিতে আবদুল লতিফ উকিল কোনদিনই বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেণ সৎ, চরিত্রবান রাজনীতিবিদ।
সমবায়ী হিসেবেও আবদুল লতিফ উকিলের অনেক অবদান ছিল। জেলার বিভিন্ন স্থানে সমবায় আন্দোলন জোরদান এবং সমবায়ের সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্যে অনেক কষ্ট করেছিলেন। চট্টগ্রামের প্রাচীনতম সমবায় প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামাবাদ টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের’ দীর্ঘ ২২ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় জেলার বিভিন্ন স্থানে সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেই সব সংগঠনের মাধ্যমে অনেক সমবায়ী জাতীয় নেতৃত্বের অধিকারী হয়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরা, অনগ্রসর বাঙালি মুসলমানদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার লক্ষ্যে মরহুম আবদুল লতিফ উকিল সমবায় সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার ও চট্টগ্রাম পৌর ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন আলহাজ্ব আবদুল লতিফ উকিল। সেই সময়ে মরহুম ও আর নিজাম, মরহুম আমানত খান বিএল, মরহুম সুলতান আহমদ দেওয়ান, সাবেক মন্ত্রী আলহাজ্ব মরহুম মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, (সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী’র পিতা), মরহুম সিরাজুল ইসলাম মাহমুদ, বাবু ফণী ভূষণ বড়–য়া, বিএল আবদুস সালাম, মরহুম শামসুল হুদা, কামাল উদ্দিন আহমদ খান প্রমুখ পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের এই কৃতিসন্তানরা সম্মিলিতভাবে নগরীর উন্নয়নে বিশেষ ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাঁরা পৌর প্রশাসনকে উন্নত ও কর্মক্ষম করার জন্যেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। সে সময়ে পৌর প্রশাসনকে উন্নত করার লক্ষ্যে গঠিত ‘চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি ওয়েলফেয়ার পার্টি’র নেতা ছিলেন মরহুম আবদুল লতিফ উকিল, উপ-নেতা ছিলেন মরহুম আমানত খান বিএল, সেক্রেটারী ছিলেন মরহুম সিরাজুল ইসলাম মাহমুদ (মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পিতা)।
১৯৪৫ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানরত বিদেশী সৈন্যদের তখনো সরিয়ে নেয়া হয়নি। ঐ সৈন্যরা ছিল দক্ষিণ ভারতীয় কালাআদমী ও গুর্খা। সৈন্যরা চট্টগ্রামের অধিবাসীদের উপর জুলুম চালাতো ও দুর্ব্যবহার করতো। একদিন এইসব সৈন্যরা হঠাৎ পাঁচলাইশ থানার কাহার পাড়ায় নারী-পুরুষ-শিশু সকলের উপর বর্বরভাবে নির্যাতন চালানো শুরু করে ও ঘর-বাড়ি পুঁড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে আবদুল লতিফ উকিল তাঁর আইনজীবী বন্ধু বদরুল হক খান উকিলকে সাথে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তখন মরহুম শেখ রফিক উদ্দিন সিদ্দিকী, মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, মরহুম আবুল খায়ের সিদ্দিকী, মরহুম এমএ আজিজ প্রমুখ সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ আবদুল লতিফ উকিলের পাশে এসে দাঁড়ান। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার বর্বর সৈন্যদেরকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সেই সময় অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন ইংরেজী পত্রিকায় মরহুম উকিল সাহেবকে “অনফঁষ খধঃরভ টশরষ: অ ঋবধৎষবংং ঋরমযঃবৎ ভড়ৎ ঃযব পধঁংবং ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব” বলে উল্লেখ করে নিবন্ধ লেখা হয়।
প্রায় একি সময়ে হাটহাজারী থানায় মাদার্শায় বাড়িঘোনার টেক কাটার যে আন্দোলন হয় সে আন্দোলনেও মরহুম আবদুল লতিফ উকিল বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ঐ আন্দোলনে, ব্রিটিশ আমলা তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে গুলি চালানো হলে আবদুল জব্বার বলী নিহত হন। গুলির হুকুমদাতা গণবিরোধী মহকুমা প্রশাসকের বিরুদ্ধে মরহুম আবদুল লতিফ উকিল আন্দোলন শুরু করেন এবং নির্যাতিত জনগণের পক্ষে তার (মহকুমা প্রশাসক) এর বিরুদ্ধে মামলা করেন। শেষ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনও সফল হয়। এই আন্দোলনে মরহুম উকিল সাহেবের পাশে যাঁরা প্রাণ পূর্ণ শক্তি নিয়ে দাঁড়ান তাঁদের মধ্যে মাদার্শা ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্ট মরহুম সৈয়দ নজির আহমদ কেরানী, ফতেপুর ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্ট মরহুম খলিলুর রহমান মুন্সী (সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম আবদুল ওহাবের পিতা) মরহুম হেদায়েত আলী মাস্টারের নাম উল্লেখযোগ্য।
আবদুল লতিফ উকিল প্রথম শ্রেণী হতে এন্ট্রাস, আইএ, বিএ, বিএল পর্যন্ত প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম বা কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তাঁর স্কুল জীবনে পড়াশুনা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলে যাঁরা তাঁর সহপাটি ছিলেন তাঁরা হলেন- সুসাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম, জাকির হোসেন (সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর), ডা: মুহাম্মদ ওমর (বিএনপি স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য মরহুম ডা: এএফএম ইউসুফের পিতা)। তাঁদের কেউ এখন বেঁচে নেই। মরহুম লতিফ উকিলের জুনিয়রদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম ইমাম হোসেন চৌধুরী, জাতীয় আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মরহুম আহমদ সোবহান, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মরহুম আলহাজ্ব বদিউল আলমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা তাঁদের গুরুর দীক্ষাকে যথাযথভাবে কাজে লাগতে পেরেছেন।
আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন মুন্সী রহমান আলী’র জেষ্ঠ্যপুত্র। ফার্সী, আরবী, উর্দু, বাংলা সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় মুন্সী রহমান আলীর যথেষ্ট দখল ছিল। আবদুল লতিফ উকিলেরও বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা ছিল। হয়ত উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পিতার গুণই পেয়েছিলেন। উকিল সাহেবের ছোট ভাই মরহুম ইউনুস মিয়া (দানা মিয়া) ও সমাজ সেবক ছিলেন। ঋণ সালিশী বোর্ড ও হাটহাজারী স্কুল পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন। মরহুম উকিল সাহেব সাংসারিক জীবনে প্রথমে বাকলিয়া মরহুম ইসমাইল মুন্সীর কন্যার (শেখ-এ-চট্টগ্রাম কাজেম আলী মাস্টারের দৌহিত্রী) সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর ঐ স্ত্রী ইন্তেকাল করলে পরে পীরে কামেল হযরত মৌলানা নূর আহমদ আল কাদেরী (রঃ) সাহেব (মোহরা, কালুরঘাট) এর ২য় কন্যাকে বিবাহ করেন। আবদুল লতিফ উকিল ৫ পুত্র ও ২ কন্যার জনক। তাঁর পুত্ররাও বুদ্ধিভিত্তিক বিভিন্ন পেশায় রয়েছেন। তাঁরা হলেন- বিশিষ্ট নিউরোসার্জন, বিএমএ সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব অধ্যাপক (ডা:) এলএ কাদেরী, আলহাজ্ব মরহুম এডভোকেট আবুল হাসনাত কাদেরী (পাকিস্তান আমলে খ্যাতনামা ছাত্রনেতা), ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের সংগঠক মরহুম এডভোকেট মুহাম্মদ নুরুল আনোয়ার (ছুট্টু), সমাজকর্মী আলহাজ্ব আবুল মোহছেনাত কাদেরী সেখু ও ইজতিহাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ও বিশ্ব প্রেস কাউন্সিল নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ সাবেক সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আলহাজ্ব মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত। জামাতারা হলেন- উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম এডভোকেট সৈয়দ হামিদুল হক ও মরহুম এসএম আবু শমসের (বাবু নগর ফটিকছড়ি)। লতিফ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই আইন পেশার সাথে জড়িত ছিলেন ও রয়েছেন। তাদের মধ্যে মরহুম এডভোকেট নুরুল আবছার মিয়া (সাবেক এজিপি), মরহুম এডভোকেট জগলুল হক খান, এডভোকেট সৈয়দ এহতেশামুল হকের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমাদের সামনে আলহাজ্ব মরহুম আবদুল লতিফ উকিল একটি মহৎ উত্তরাধিকার রেখে গেছেন- সে উত্তরাধিকার হচ্ছে রাতারাতি বড়লোক বনা বা বাড়ি-গাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক হবার পথ নয়, বরং জনসেবার, দেশ সেবার, জাতি সেবারই পথ। মন্ত্রী না হয়ে মৃত্যু বরণ করা অগৌরবের কিছু নয়। পৃথিবীর বহু কৃতি পুরুষ মন্ত্রী না হয়েও জনসেবা করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং কীর্তি-কর্মের জন্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আবদুল লতিফ উকিল ১৮৯৫ সালের ১ মার্চ হাটহাজারী ফটিকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯৬৫ সালে ২০ জানুয়ারি, ১৬ রমজান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে—-রাজেউন)। হাটহাজারীস্থ পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন হাটহাজারী মাদ্রাসার তৎকালীন মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব (রঃ) মরহুম মগফুর।
জনগণের প্রতি অসাধারণ ও অকৃত্রিম ভালবাসা, নির্যাতিত-শোষিত মানুষের সংগ্রামের প্রতীক ও বাঙালি মুসলমান আইনজীবীদের নব জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে আলহাজ্ব আবদুল লতিফ উকিল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ