দ্বীপান্বিতার আত্মহত্যা কেউ মানতে না পারলেও আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। আত্মহত্যা না করলে, ও নিজের প্রতি অবিচার করতো। ওর আত্মহত্যা ওর বাবা ভাইকে এক ধরণের মুক্তি এনে দিয়েছে। ওর ভাই ঘর থেকে বেরুলে সুযোগ বুঝে সবারই জিজ্ঞাসা ছিল- ‘তোমার বোনটার এখনও বিয়ে হয়নি ? বয়স তো কম হল না, অনেকে আবার লোক দেখানো আফসোস করে, ‘ইস্, মেয়েটার কেন যে এমন হল?’
দ্বীপান্বিতার বাবা মানত করেছিল, আমার অন্ধ দ্বীপান্বিতার যদি বিয়ে হয় তবে দেখে দেখে সব মাজার জিয়ারত করে আসবে। বাবা ছিলেন প্যারালাইসিস্ রোগী। বামন বাবার চাঁদ ধরার স্বপ্নে আমি হাসলেও দ্বীপান্বিতা কেঁদে ফেলতো। ওর মা বেচারী সারাক্ষণ নফল নামায আর হুজুরী বিদ্যায় পারদর্শীদের কাছ থেকে নানা পরামর্শে ডজন খানিক তাবিজ দ্বীপান্বিতার গলা ও কোমরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। তবু বেচারীর কপালে বিয়ে জুটল না। দ্বীপান্বিতাকে যতটুক দেখেছি চুপচাপ থেকেছে। বুঝতাম জৗবনটা তার কাছে বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে অবুঝ শিশুর মতো কেঁদেই ফেলতো। আমি বলতাম যে চোখে আলো নেই সে চোখে এত জল কেন রে? দ্বীপান্বিতা ধর্ম কর্ম মেনে চলতো। কিন্তু ঈশ্বর ব্যাটা তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। একারণেই হয়তো দ্বীপান্বিতা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ওর জন্য আমি কখনো কাঁদিনি। তবে মায়া হতো। ঈশ্বর কেন যে রঙ্গ করে বুঝিনা। ওকে অন্তত আর দশটা মেয়ের মত সুন্দরী বানানো যেত। ওর বাবা মা কে ‘কন্যা দায়’ থেকে মুক্তি দেয়া যেত। কিন্তু দ্বীপান্বিতার জন্য সবটাই প্রহসন। কিছুই পেলনা। শেষবার যখন বিয়ে ঠিক হল ওর খালাত ভাইয়ের সাথে, ও বলেছিল এখানে কোন স্বপ্ন নাই, কোন ভালবাসা নেই, শুধু বাবা ভাইয়ের কাঁধ থেকে ‘আমি বোঝা’ টা হালকা করা। শেষ পর্যন্ত তাও হল না। দ্বীপান্বিতা বোঝাটা কেউ গ্রহণ করলো না। পাল্টা অপবাদ অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে ও চুপ হয়ে গেল।
দ্বীপান্বিতা হাঁটতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ওর ডান পা আর ডান হাতে সমস্যা ছিল। ওর ধারনা ছিল, ওর কথাবার্তা এতো সেকেলে এতো পুরানো ছিল যে, ও কথা বললেই আমি বিরক্ত হতাম। ওখানে শেখার কিছুই ছিল না। ওর চোখের দিকে আমি কখনো তাকাইনি। ওর চোখে মুখে সৌন্দর্য্যের কিছুই ছিল না। তাই হয়তো আমাকে টানেনি। তবু আমি বুঝতে পারতাম ওর অন্ধ চোখে আকাশ, গাছ, মাটি, মানুষ, পুরুষ সব বুঝত। ওর ইচ্ছেগুলি শৃঙ্খলিত ছিল। চাওয়া গুলি ছোট ছিল। ভালবাসায় সীমারেখা ছিল। খুব নিসঙ্গ ছিল। প্রায়ই মাঝরাতে ট্রেন বা ষ্টিমারের শব্দে আচমকা কেঁদে উঠত।
দ্বীপান্বিতার আত্মহত্যার খবর যখন আমার কাছে পৌঁছাল আমার খুব বেশি খারাপ লাগেনি। মোটামুটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ওর মৃত্যু ওর বাবা ভাইকেও স্বস্তি এনে দিয়েছিল। ওর জন্য কেউ খুব বেশি কাঁদেনি। কেউ কেউ বলেছিল দোজখি একটা, কোন রকমে পুঁতে ফেল। ওর মা কেঁদেছিল কিনা জানিনা।
আজ আকাশে অষ্টাদশী চাঁদ। নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। অনেকদিন পেরিয়ে গেল দ্বীপান্বিতা নেই। ওর কথা খুব মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর পুরানো একটা ক্ষত আজ ব্যথায় টনটন করছে। জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের ভুল উচ্চারণের ভুল ভালবাসার আগোছালো দ্বীপা কেমন আছে?
আত্মহত্যা করলে নাকি অশুভ আত্মা ভর করে। দ্বীপা কি পেত্নী হয়ে যাবে? হউক না পেত্নী। ও তো একটা রূপ পাবে। ওর জন্য মন্দ কি? ও যখন বেঁচে ছিল, ওকে আমরা কোন রূপই দিতে পারিনি। না মানুষ্যরূপ না পেত্নী রূপ? কেউ বলত জ্যান্ত পেত্নী একটা, কেউ বা হাতি কেউ বা অপয়া বলে ডাকত।
ছোটবেলায় অমাবস্যার রাতে বাতাসে মাংসের গন্ধ ভাসলে দাদী বলতো আজ তেঁতুল তলায় পেত্নীর বিয়ে হচ্ছে। ভয়ে বের হতাম না তখন। আর আজ ভাবছি কোন এক ঘোর অমাবস্যায় অন্ধকারে তেঁতুল তলায় গিয়ে বাতাসে মাংস ভাজার গন্ধ খুঁজবো। যদি পাই তবে ধরে নিবো সেদিন দ্বীপান্বিতার বিয়ে। আর আমি অন্ধকারে হাঁটুমুড়ে বসে চিৎকার করে বলবো, ‘বিয়ের কন্যা, নিচে নেমে আয়। তোকে একবার প্রান ভরে দেখি। সানাই বাজিয়ে, মানুষকে খাইয়ে, রং বে-রঙের কাগজ কেটে কোন পুরুষ তোকে ঘরে তুলল না তাতে কি? তুই তো মাথা নত করিস নি। ভিন্ন একটা পথে হেঁটে গেছিস। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ও র্স্বাথান্বেষী মানুষের মুখে দিয়েছিস ঘৃণার প্রলেপ। তুইতো সত্যিই জয়ী। প্রণাম তোকে।’