ঈশ্বরও কবিতা লেখেন
রাত বাড়লেই আকাশ হাঁটু ভেঙে নীচে নেমে আসে অনেকটা, ঘরজোড়া অন্ধকার, ছেঁড়া শিমুলের মতো পাহাড় ছেড়ে উড়ে এসে একেকটা হিম মশারির চারপাশে টেক অফ করে। আমার মগজ জুড়ে এখন দর্শন বলে আর কিচ্ছু নেই, বুকঠাসা শ্বাসকষ্ট, এরাই কবিতা
রাতের শেষ বয়সে বিছানার চারপাশে ভ্রাম্যমান ভুলগুলো তারস্বরে কোরাস গাইতে থাকে, প্রহর ভাঙতে ভাঙতে একসময় গ্রহণ লেগে যায়, আমার ঘুম পায়, ভীষণ ঘুম পায়, ঘুমঘোরে আমি আরও অনেক ভুল লিখে লিখে ছড়িয়ে দেই ঘরময়
অন্য কোথাও ঠিক এই সময়ে একটা মেয়ে বিছানা ছেড়ে ঝুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখে একটা পাগল বুকের জানালা খুলে মৃত শিশুদের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে রঙিন বেলুন, আর ওরা ধরতে পারছেনা বলে ঐসমস্ত রাশি রাশি বেলুন মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে
রাজ্যের হাহাকার নিয়ে পাগল লোকটা গুঙিয়ে ওঠে, হে ঈশ্বর, দেখ দেখ কি নিষ্ঠুর! আমার কাছ থেকে কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে কবিতা, বরাবরের মতনইঈশ্বর কিছুই বলেন না, তাঁর নীরবতা তাঁর ভাষা, আঁধার কাটছে, মেঘের খোঁপায় ফুটছে আলোর ফুল
উদভ্রান্ত সহিসের ছদ্মবেশী সময়
এসেছে মাহেন্দ্রক্ষণ, মঞ্চ তৈরী খুব, আজ নৈর্ঋত
দিক থেকে নেমে এসে ছুঁয়ে দেব তোমার
বহ্নিশিখা, এই যে এতোটা মেলেছো নিজেকে
ফেরাতে পারবেতো?
হয়তো
চোখ পাকিয়ে বলবে, ভাল হলনা কিন্তু, উষ্মা লুকিয়ে
অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকবে মাছরাঙার মতো, আমি
মোটেও চমকে যাবনা, এ আর নতুন কি বলো, সেই
আদিকাল থেকে পৃথিবীর রোজ ঘুম ভাঙে প্রতিশোধ
স্পৃহায়।
সময় তবুও এ পাড়ার দাসু পাগলার মত –
সারাক্ষণ কিছু একটা হন্যে হয়ে খুঁজছে; তৃষ্ণার্ত বুকে
তার হাঁটছে কেউ অবিরাম মুগ্ধতায়,কখনো
ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়যদি, তার দায় কে নেবে?
তুমি?
রূপাগ্রস্থতা
১
সাঁকোর গল্প পুরনো হয়েছে বহুকাল, বিলুপ্ত স্মৃতি কামড়ে রয়েছি তবু। রূপা পেরিয়ে গিয়েছে বহুবার, শেষবারে ফেরেনি, শুধু যাবার গল্পের রেশ রয়ে গেছে। নেই সাঁকোটার কাছাকাছি এখন চৌরাস্তা, নাভি থেকে পথ এঁকে বেকে গ্যাছে, আরেকটু এগুলেই গোল পাহাড়, জিলিপি পাহাড়, খুলশি, কাজীর দেউরী, ওড়না লেইন, পাঞ্জাবী গলি। অথচ চৌরাস্তা ধরে আমি যতবার এগুই আমার সমস্ত পথ নেই সাঁকোটার কাছে চলে আসে। ওটা রূপা’র ছিল হয়তো কোনকালে, আমি অতিথি, কখনো নিমন্ত্রণে চোরা রোদের ওপিঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গড়ানোর ভঙ্গিতে আমরা কথা বসাতাম। রূপা জানেনা, রূপাতো নির্ঘাত জানেনা কোজাগরী রাতে মধ্যবর্তী সেতুতে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষায়, একজন ফিকে মানুষ, এখনো।
২
রূপাদের বাড়ির ছবি আমার ক্যালেন্ডারে চাপা পড়ে আছে। বর্গী-পাড়ায় জন্ম যেহেতু আমার কেবলই ছিনিয়ে নেবার লোভ, যতবার ও বাড়ি গেছি ততবার সোনাঝুড়ির সিঁড়ি ভেঙে আমি টপকে গেছি তৃষ্ণার্ত বেপাত্তা কিছু স্মৃতি, বিনিময় প্রথা। একবার দেখি ‘ও’ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে, আমার দিকে নয়, একুরিয়ামের সদ্য অতিথি গোল্ডফিসটার দিকে, যদিও ওই বন্দি মাছটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তবু বর্গী যেহেতু আমি তাই পুনরায় ছক পেতে বসি, মাছটা কিছু বুঝতে পেরেছিল কিনা জানিনা, শুধু দেখেছি রূপার পাশে দাঁড়ালেই সে লেজ নাড়িয়ে একুরিয়ামের গভীরে চলে যেতো।তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম রূপার চুলের দিকে, এমন আঁধার আমি জীবনে দেখিনি।
৩
ওর সাথে বেড়াতে গিয়ে একদিন পাঁচ টাকার কয়েন ফেলেছিলাম যন্ত্রে, ভবিষ্যৎ ছাপা হয়েছিল ছোট্ট কাগজের টুকরোয়- অর্জুন তুমি, পাবেই দ্রৌপদীর ভালোবাসা, কুরুক্ষেত্র থেমে গেলে। পড়ে, ঝর্না গলায় হেসেছিল রূপা।ঝর্নার ওই জল কি কেবলই জল, মাথার ওপরে এই যে আকাশ, সে কি আকাশের চাইতেও বেশি নয়! আমরা কেউ তখনোততখানি নিসর্গ-শিকারি ছিলাম না, নতুবা আমার সব সমর্পণ, সব প্রতিবাদ, আধখানা জ্বরে পুড়ে যেতো! এখনো জানতে পারিনি আমাকে জরীপ করে কি পেয়েছিল রূপা। প্রস্তুতিবিহীন বিপন্নতা?
৪
গভীর আয়নার সামনে অনাদিকাল একটা মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, এখন আর আমার মধ্যে কোন কিন্তু নেই, অথচ মৃত্যুর অধিক তৃষ্ণা বুকে, মনে পড়লেব্যস্ত সময় এক লহমায় পিছিয়ে হপ্তা, মাস, বছর হিসেব নেই। চুমুর চেয়েও ঘনিষ্ঠ কিছু কি ছিল তোমার বিদায় সন্ধ্যাবেলা? অতটা দহন কি করে সহ্য করে আছি! আমার পতন-প্রবণ মন, আমার বুকের পাটাতন, লুকিয়ে রেখেছে বিষাদের ইন্সটলেশনগুলো। রাত জাগি, জুয়াড়ির মত ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে, যন্ত্রণার চড়াই শরীর বেয়ে ওঠে, ইতিহাস হাতড়ে কুহুভর্তি গেলাস খুঁজি। জানালা গলে হুমড়ি খায় বেগম আখতার- জোছনা করেছে আড়ি…
৫
আজ যখন নিঃসঙ্গতার কথা ভাবছিলাম, নাটকীয়ভাবে বিদ্যুৎ চমকায়নি আকাশে। আমার কাছে রেখে যাওয়া রূপার সেই গোল্ডফিস আমাকে দেখতে পেয়ে তিনবার লেজ নাড়িয়েছিল। তাকে রোজ খাবার দেই, স্নান করাই। তবু তার প্রতি বিদ্বেষ বেড়েছে, সে পুরনো বন্ধুকে ভুলে গ্যাছে খুব সহজেই, অথচ তার এবং আমার জয়েন্ট বুক ক্ষত বিক্ষত ছিল। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে, যে কথা রূপাকে বলিনি কখনো, গোল্ডফিস জানে। ওর মৌন ভাষা আমি শুনতে পাই, বলে, শরীরও ভালবাসা, ভালবাসা উত্তাপ, তাকে যৌনতা বলা নিতান্তই অপরাধ বরং এসো কিছুদিন খুব কাছাকাছি থাকি।
৬
করোটির শাঁসভূক গ্রন্থিগুলো গড়াতে চাইছে জলে, হে ঈশ্বর যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, তবে কেন খাঁচা দিলে বাঁধিবার! যদি ফিরে এসো এ শহরে কোন সন্ধ্যায়, যদি দেখ আকাশের গায়ে ভ্রুকুটির মত চাঁদ, আর সাঁকোতে দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা শরীর হৃদয়ের কাছে ক্ষমা চাইছে, রূপা তুমি চমকে যেওনা।
ড্যান্স এরাউন্ড দ্যা ফায়ার – উপকথা
১
ঘুম খুলতেই সকাল এসে হাত ধরে নিয়ে যায় আরেক দিনের উঠোনে, চোখ ভাসলে চমকে যাই, চিঠিরা সব ভুল ঠিকানায় আজকাল, কফিনের মত সারি সারি কুয়াশা কপাট, শীতের পাখিরা উড়ে আসে, তবু শীতকালের দেখা নেই, কেউ বদলে ফেলছে পুরনো ঠিকানা, এমনকি জন্মের দাগ, সবগোপন চিহ্ন সমেত, শুরু হয়ে গেল তবে শব বিয়োনর রেওয়াজ!
২
চোরা বিষণ্ণতা নিয়ে বাতাস মাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে ভোকাট্টা ঘুড়ির আড়ং, সকল সময়, উচ্ছ্বাসের দিনগুলো এখন জ্বেলে দেবে নেপথ্যে আগুন, পুড়ে যাবে আকাক্সক্ষার সেতু, পুড়ে যাবে সরল পুষ্পের র বোধ, পুড়ে যাবে নাকাল বেহালা, দাউ দাউ পুড়ে গেল উনুনের সব গান, সন্ধ্যার আলো ঠোটে নিয়ে উড়ে গেলে গাঙচিল, ঘুমিয়ে পড়ে লাটাই, শুধু আমি জেগে থাকি, আশার অশ্বে চেপে থাকা এক মমি, অন্যমনস্ক। কে এই ‘আমি’!
৩
সাপ যেমন নিজের আততায়ীর ছবি তুলে রাখে নিজের চোখে, পরে সঙ্গী সাপ সেটা দেখে বদলা নেয়, রিভেঞ্জ, মুখের কোলে জ্যামিতিক ভাবনা, গাঢ় চায়ের কাপে তোমার ছায়া, না ছায়া নয় শুধু, যেন লিকারে ডুবছে কনডেন্সড মিল্ক, ঠোঁটের ত্রিকোণমিতির খেলায় ফুটতে ফুটতে ফাটছে চেতনা, চুমুক দিতেই উথলে উঠছে করতালি, সিরিয়াস বায়স্কোপ শেষে পর্দা নামছে, ক্ষুধা আর কৃষিস্বপ্ন নিয়ে লোকেরা বাড়ি ফিরে যাবে, তবু বুক জুড়ে আমি কেবলই ধৈর্যের শো দেখাই, ভেবোনা, কখনো কারো গিলোটিন হবনা, এটাও অহং!
৪
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়”- আমি কি ছাই জানি, বিদেশী পর্যটক কি ভাষায় কথা বলে, সূর লাগায়, বুঝিনা কিছুই, পথ সবই জানে, জানেনা পথিক, আমি দেখি ওম মাখানো মেঘলা দুপুর, ঘরোয়া রোমান্টিকতা, নাভি থেকে উঠে আসছে অস্পষ্ট অক্ষর, লোকে যা জেনেছে সমস্তভুল, সত্য শুধু তুমি আর আমি, ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে গুজে রাখা হারানো সে মেয়েটির চিঠি লেখা পাতা পুড়ে যাচ্ছে, জানালার ওপারে মিইয়ে যাচ্ছে আলোর ফিলামেন্ট, নশ্বরতারতো বয়স কম হলনা, আর কত!
৫
শহরের সব কটা মুখ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে আর দেখিনি, এমন ভাবনার কোলে জখমি সন্ধ্যা দোলে, বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া জল কখনো ফিরে আসে এক একটা সুনামী হয়ে, আমি ভাঙ্গা ব্রিজের ওপর উঠে পড়ি, যার দু’পাশটা বিচ্ছিরি রকমের ফাঁকা, অথচ, অনুগত আঁধার বলছে আবার উৎসব হবে, যেমন প্রতিটা তারাই থাকে রোদের বুকপকেটে, যেমন আগুনেরও কখনো কখনো পুড়ে যেতে সাধ হয়, যেমন সকল চোলি’র নীচে কেবলই স্তননয়, মন বলে কিছু আছে, আমি তেড়ে ফুঁড়ে তার গালে মিথ্যা ছুঁড়ে মারি।