মনের ভাব প্রকাশের জন্যই মানুষ কথা বলে, লেখে। কিন্তু তারপরও অনেক কথাই থাকে, যেগুলোতে কিনা আরও বৃহৎ অর্থ লুকায়িত থাকে। এই কারণেই প্রচলন হয়েছে ভাবসম্প্রসারণের। এর মাধ্যমে অনেক লুকিয়ে থাকা ভাব সম্পর্কে জানা যায়। এমন এমন ভাব, যা আপনারা হয়তো কখনো ভাবেনইনি!
স্কুলজীবনে ভাবসম্প্রসারণ না লেখা এবং না পড়া মানুষ এই দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে হ্যাঁ, আমরা আজ আপনাদের সামনে হাজির করতে চলেছি এক নতুন ধরনের ভাবসম্প্রসারণ। তার পোশাকি নাম হলো ‘রম্য ভাবসম্প্রসারণ’। ভাবসম্প্রসারণ পড়তে পড়তে বিরক্ত যে কেউ ‘ধুর, ছাতার মাথা’ বলে মনে মনে যে ভাবের সম্প্রসারণ করে, সেটিই হলো রম্য ভাবসম্প্রসারণ। এবার তাহলে পড়েই নিন তেমনই একটি ভাবসম্প্রসারণ।
‘দেখেন, যেটা ভালো মনে করেন!’
মূলভাব
হাজারবার বলার পরও যখন কেউ কিছু বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না, নিজে যে বোঝে না তাও বোঝে না এবং উল্টো নিজের বুঝ না বুঝেই অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন যে নিরাসক্ত, হতাশাবাদী ও ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ঘরানার মানবভাবের উৎপত্তি হয়, সেটিরই সার্থক বাক্যগঠন হলো—‘দেখেন, যেটা ভালো মনে করেন!’
সম্প্রসারিত ভাব
এই নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না কেউ চিরদিন। একদিন না একদিন সবাইকেই মরে যেতে হয়। আবার যতদিন বেঁচে থাকা, ততদিন মানুষ ঘুমানো বাদে বাকি সময় চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করে। তবে সব সময় চোখ খোলা রাখলেও অনেকে আক্রান্ত হন দিনকানা বা রাতকানা রোগে। যাদের রাতকানা রোগ, তারা সব কাজ দিনে সারেন, এমনকি চুরি–ডাকাতিও। আবার যাদের দিনকানা রোগ, তারা রাতেই সব কাজ করতে চান, এমনকি পরের দিনের খাবারও রাতে খেয়ে ফেলেন। এর মধ্যে এসব রোগে অনাক্রান্তদের কারও কারও সব সময় চোখ খোলা থাকলেও, তারা ঠিকমতো সব কিছু দেখতে পায় না। কখনো কখনো দেখতে পারলেও ‘ভালো’ মনে করতে পারে না। অথচ ‘ভালো’ মনে করে, বিচার–বিশ্লেষণ না করেই, যেকোনো কিছু (সেটি খারাপ কাজ হলেও) ইচ্ছামাফিক করে ফেলাটাই এ যুগের মানবধর্ম। কথায় আছে, মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। এক্ষেত্রে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে। আমরা ভাবি একটা, আর ‘মনে করি’ আরেকটা। এই মনে করাটাই আসলে সব। যদি ধানখেতকে আমরা বেগুনখেত মনে করতে পারি, তাহলে সেটা বেগুনখেতই। এভাবে ‘ভালো’ মনে করে গাছের একটি নির্দিষ্ট ডালের আগায় বসে করাত দিয়ে সেই ডালটির গোড়াও কেটে ফেলা যায়। আসলে আগে ‘মনে করতে’ হবে যে এটিই ‘ভালো’ উপায়। ডাল কাটাটাই মূল কাজ। আবার সেটি কেটে গাছ থেকে মাটিতে নামতেও হয়। সাদা চোখে দেখলে ডালে বসে ডাল কাটাটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এ ব্যাপারে মহামতি সাহিত্যিক রোল্ড ডাল বলেছিলেন, ‘কোনো কিছু করে পার পেয়ে যেতে চাইলে কখনও কোনো কিছু অর্ধেক করবেন না। দুঃসাহসী হন। সর্বোচ্চ সীমায় যান। নিশ্চিত করুন যে, যা কিছু আপনি করেন তা এতই পাগলাটে যে অবিশ্বাস্য মনে হয়।’ আর এমন অবিশ্বাস্য কাজ ভালো ‘মনে করে’ করে ফেলতে পারলেই এই বঙ্গদেশের ‘সফল’ সন্তান হিসেবে সার্থকতা মিলবে। এবং ডালের আগায় বসে গোড়া কাটার কাজটি দেখেও যখন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি পূর্বঅভিজ্ঞতাজাত অভিজ্ঞানে ভর করে, ডাল কাটার পরের দৃশ্য আন্দাজ করেও মুখে কিছু না বলে মনে মনে ‘নিশ্চয়ই দেখেছে, ভালো মনে করেছে’ শীর্ষক মানসিক স্থিরতায় উপনীত হন এবং নিজের ঘাড় বাঁচাতে ডান বা বাম পাশে সরে দাঁড়ান নিরাসক্ত ঢঙে, তখনই এই সুবিশাল মহাবিশ্ব শ্রবণ করে অনুচ্চারে উচ্চারিত একটি মহান বাণী—‘দেখেন, যেটা ভালো মনে করেন!’ মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যারা সফল হয়েছে, তাদের সাফল্যের ঠিক পেছনেই রয়েছে পরিশ্রমের জাদু। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক পেছনেই। যারা ডালে বসে ডাল কাটেন, তারাও পরিশ্রমকেই নিজেদের জীবনের পাথেয় করেছেন। পরিশ্রম, তা যে পথ দিয়েই আসুক না কেন, বৃথা যায় না। এই দুনিয়াতে পরিশ্রম ছাড়া ভালো কিছু অর্জিত হয়নি কখনোই। আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে চোখ বন্ধ করে তাকালেও দেখা যাবে, নিরলস পরিশ্রমেই তারা পৌঁছে গেছে উন্নতির চরম শিখরে। হয়তো ডালের আগায় বসে গোড়া কাটলে শিখরের বদলে শিকড়ে পৌঁছে যেতে হতে পারে, কিন্তু কোনো পৌঁছানোই কখনো ব্যর্থ হয় না।
মন্তব্য
চোখে দেখা ও ‘ভালো’ মনে করা—এই দুটি বিষয়ই মানবসভ্যতার উন্নতির হাতিয়ার। যারা ‘ভালো’ মনে করে যা খুশি তাই করতে পারে, তারাই মানবজাতির পথপ্রদর্শক। আর এই পথপ্রদর্শকদের পথ দেখায় একটি বাক্য, সেটি হলো—‘দেখেন, যেটা ভালো মনে করেন!’ এই বাক্য মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে ইলন মাস্কের দ্রুতগামী রকেটের মতো গতি এনে দেয়। দেয় উন্মুক্ত আকাশে চিলের মতো উড়ে বেড়ানোর ট্রাভেল পাস। তবে এক্ষেত্রে কান নিয়ে গেছে শুনেই চিলের পেছনে দৌড়ানোর অভ্যাস জারি রাখতে হবে। নইলে অলীক কল্পনার বন্দোবস্ত চিরকালই অধরা রয়ে যাবে। তাই অন্যের উদ্দেশে সব সময় বলুন—‘দেখেন, যেটা ভালো মনে করেন!’ সেই সঙ্গে অন্যকে উৎসাহিত করুন যেন তারাও আপনাকে একই কথা শোনায়। তাহলেই জীবন হয়ে উঠবে সার্থক ও সুন্দর!