১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দীপন হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন জামায়াত ও উগ্রপন্থার ৬-৭ জনকে পুলিশের নজরদারি

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন ৬-৭ জনকে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা জামায়াত-উগ্রপন্থা অনুসারী। তবে একই দিনে প্রগতিশীল দুই প্রকাশকের ওপর হামলার পেছনে কারা রয়েছে সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। দুই ঘটনার যে কোনো একটি গ্রুপকে ধরার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এদিকে প্রকাশক দীপন হত্যা ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার দুই দিন পরে দায়ের করা এ মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। দুটি মামলাই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি খুনিরা। পুলিশ কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন টুটুলসহ তিনজনের অবস্থা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এক প্রকাশককে হত্যা ও আরেক প্রকাশকসহ তিনজনকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় একাধিক গোয়েন্দা টিম মাঠে নেমেছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছায়া তদন্ত করছেন। প্রযুক্তি সহায়তা ও ম্যানুয়াল সোর্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ জব্দ করে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এসব ঘটনায় জঙ্গিবাদকেই অন্যতম সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। কারণ প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করা হয়েছে দীপনের জাগৃতি প্রকাশনী ও টুটুলের শুদ্ধস্বর থেকে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিদের বিশেষ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সম্পৃক্ততার সন্দেহ রয়েছে। অভিজিতের বই প্রকাশ করায় টুটুলকে হুমকিও দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দীপন ও টুটুলের পারিবারিক, ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়েও তদন্ত চালানো হচ্ছে। কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দীপন হত্যাকাণ্ডে ৬-৭ জন সন্দেহভাজনের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে। তারা জামায়াত-জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুটি ঘটনায় আলাদা কিলার গ্রুপ হলেও নেপথ্যের নায়ক একই গোষ্ঠী বলে মনে হচ্ছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে একই সময়ে, একই কায়দায় দুটি জায়গায় হামলা চালানো হয়। এর একটি গ্রুপকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা গেলেই রহস্য বেরিয়ে আসবে।
ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, দুটি হামলার ঘটনায় ডিবি সর্বাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তি সহায়তা এবং ম্যানুয়াল সোর্স নিয়োগের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার  জানান, শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় বেশি কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এসব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। টুটুলের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতাসহ সব দিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হলেও তদন্তে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করায় হুমকি দেয়ার অভিযোগে ২৮ ফেব্রুয়ারি থানায় একটি জিডি করেছিলেন টুটুল। সে সময় তাকে নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া হয়। এই হুমকিদাতা গোষ্ঠী না অন্য কোনো গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে বলে জানান বিপ্লব সরকার।
দুই মামলা: শাহবাগ থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, দুপুর সোয়া ২টায় নিহত দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে কাজ করছে পুলিশ।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দীন মীর জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল বাদী হয়ে বেলা আড়াইটার দিকে মামলাটি দায়ের করেন। তার একজন স্বজনের মাধ্যমে এজাহারের অভিযোগটি তিনি থানায় পাঠিয়ে দেন। হত্যা চেষ্টার এই মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, মামলা দুটি রাতে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ঢাবিতে চিকিৎসাধীর ৩ জনের অবস্থা উন্নতির দিকে: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. উজ্জ্বল কুমার সাধু খাঁ জানান, তিনজনই ভালো আছে। তাদের অবস্থা উন্নতির দিকে। এর মধ্যে তারেকের জীবন শঙ্কামুক্ত হলেও বাঁ হাতটি নিয়ে শঙ্কিত। সার্জারি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। হাতটি রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তার বাঁ পাঁজরে গুলি থাকলেও এখনই তা বের করা হচ্ছে না। আর টুটুলের ডান গাল ও কপালের ডান দিকে দুটি অস্ত্রে আঘাতের ক্ষত রয়েছে। তবে তার বাইপাস সার্জারি, ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেসার থাকায় তা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তার অবস্থা ভালো। রণদীপমকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যার পর খুনিরা কার্যালয়টি বাইরে থেকে দরজা তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। দীপন জাগৃতির কর্ণধার। এর আগে লালমাটিয়ায় সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীরা একই কায়দায় কুপিয়ে আহত করে প্রকাশনার মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল এবং তার দুই বন্ধু লেখক-ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু সুদীপকে। এ সময় গুলিও চালায় হামলাকারীরা। একটি গুলি তারেকের পাঁজরে বিদ্ধ হয়েছে। হামলার পর দরজার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যায় খুনিরা।

জাগৃতি থেকে ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ এবং শুদ্ধস্বর থেকে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করা হয়।

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক, ব্লগার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়কে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে স্ত্রী বন্যাকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। স্ত্রীকে কোপানো হলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ