বাবা-মা ছাড়াই বাংলাদেশে তেরশ’ রোহিঙ্গা শিশু পাহাড় ধস ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা, হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে দুই জনের মৃত্যু, শুরু হয়নি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ
জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার তিনশো শিশুকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে যারা বাবা-মা বা কোনও আত্মীয়-স্বজনকে ছাড়াই বাংলাদেশে এসেছে। সাহায্য সংস্থাগুলোর ধারণা, এসব শিশুর বাবা-মার দুই জনকেই অথবা বাবাকে মিয়ানমারে মেরে ফেলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের হিসেব মতে প্রতিদিনই গড়ে দশ থেকে পনের হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে, যার একটি বড় অংশই শিশু। ইউনিসেফের কর্মকর্তা মাধুরী ব্যানার্জি বলেন, রবিবার পর্যন্ত ১৩১২ জন শিশুকে পাওয়া গেছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অর্থাত্ পিতা মাতা বা স্বজনদের ছাড়া। তাদের সহায়তার চেষ্টা করছি আমরা। মানসিক বা ট্রমা থেকে তারা যেন বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক হতে পারে সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিবিসি জানায়, মিয়ানমার থেকে আসা মোহাম্মদ নুর বলেন, এসব শিশুদের বাবা মাকে মিয়ানমারের সেনারা মেরে ফেলেছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার হিসেব অনুযায়ী এ দফায় নতুন করে আসা শিশু সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। স্থানীয় একটি ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, তার ধারণা যতো শিশু এসেছে তার প্রায় অর্ধেকের সাথেই বাবা নেই। অন্তত ৪০ শতাংশ আসছে অভিভাবক ছাড়া।
উখিয়া থেকে আজহার মাহমুদ ও রফিক উদ্দিন বাবুল জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি অংশ এখনো খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। প্রাণ বাঁচাতে কোনোমতে এপারে পালিয়ে আসলেও এখনো থাকার জায়গা পায়নি তারা। আবার অনেকে জায়গা পেলেও সামর্থ্যের অভাবে ঘর বাঁধতে পারছেনা। নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দের নির্মাণকাজও এখনো শুরু হয়নি। খোলা আকাশের নিচে তাদের দিন কাটছে। ঝড় বৃষ্টিতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আবার পাহাড়ের উপরে কিংবা পাদদেশে অবস্থান নেয়ার কারণে পাহাড়ধ্বস ও মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা করছেন কেউ কেউ। এদিকে হাতির পায়ে পিষ্ঠ হয়ে দুই রোহিঙ্গা মারা গেছে।
বালুখালী এলাকায় করিমুল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা জানান, তিনদিন আগে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ হয়ে উখিয়ায় এসেছেন তিনি। কিন্তু এখানে আসার পর দেখতে পান, আগে থেকে যারা এসেছেন তারা বিভিন্ন এলাকার জায়গা দখল করে আছেন। বালুখালী এলাকায় একটি জায়গা পেলেও জায়গার মালিক তাদের ঘর বাঁধতে দেননি। তাই ওই জায়গার পাশেই ৫ জনের পরিবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি।
ইতিমধ্যে অনেকে থাকার জায়গা পেলেও নিচু ভূমি হওয়ায় সেখানে পানি উঠছে। ফলে তারা ওইসব জায়গা ছেড়ে উপরিভাগে আশ্রয়ের স্থান খুঁজছেন। তেমনই একজন মোহাম্মদ কুতুব। তিনি বলছিলেন, বালুখালী এলাকার পাশে একটি নিচু জমিতে তিনশ’র বেশি রোহিঙ্গা পরিবার অস্থায়ী থাকার ঘর বাঁধে।
কিন্তু গত দুইদিন বৃষ্টিতে সেখানে পানি উঠে গেলে তারা সবাই থাকার জায়গা খুঁজতে বের হন।
এদিকে রাস্তার অতি নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে যারা ঘর বেেঁধছেন তাদের সেখান থেকে স্থানীয় প্রশাসন তুলে দিচ্ছে। এতে তারাও নতুন করে দুর্ভোগে পড়ছেন। কুতুপালং বাজারের দক্ষিণ পাশে উখিয়া টেকনাফ সড়কের ধারে এমন একটি ঘর বেঁধেছিল হোসনে আরার পরিবার। কিন্তু প্রশাসন তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, অনেকেই অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার পাশে ঘর তৈরি করায় গাড়ি ও লোকজনের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। তাই তাদের তুলে দেয়া হচ্ছে। তাদের সবাইকে নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির নির্মাণে দুই হাজার একর জায়গা নির্ধারণের এক সপ্তাহ পার হলেও এখনো পর্যন্ত সেখানে দৃশ্যমান কোনো তত্পরতা নেই। যদিও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান মুক্ত জানিয়েছেন, দাপ্তরিক অগ্রগতির কারণে কাজ এখনো শুরু হয়নি।
পাহাড় ধ্বস ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শংকা : বন জঙ্গল ও পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে আশ্রয় নেওয়া, সেখানকার গাছপালা উজাড় এবং অব্যহত বৃষ্টির কারণে উখিয়ার অনেকস্থানে পাহাড় ধ্বসের আশংকা করছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। তারা বলছেন, যেভাবে পাহাড়ের উপর রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপর টানা বৃষ্টির কারণে যে কোনো সময় পাহাড় ধ্বস হতে পারে।
কক্সবাজার পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক দিপক শর্মা দিপু বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যে পাহাড়গুলোতে অবস্থান নিয়েছে সেগুলো বালুমাটির পাহাড়। যে কোনো সময় এসব পাহাড় মারাত্মকভাবে ধ্বসে পড়তে পারে।
হাতির পায়ে পিষ্ঠ হয়ে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু : উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে মধুরছড়া পাহাড়ে বন্য হাতির পায়ে পিষ্ঠ হয়ে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন, শামসুল আলম (৫৫) ও সৈয়দুল আমিন (১১)। গত রবিবার রাতের এই ঘটনায় আরো দু’জন আহত হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি রাখাইন রাজ্যে ও মংডু জেলা ডেকিবুনিয়া গ্রামে।
বৌদ্ধ নেতারা মিয়ানমার যাবেন, হবেনা ফানুস উত্সব : রোহিঙ্গা নিধনের প্রতিবাদ জানাতে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের নেতারা মিয়ানমার যাবেন। তারা সেদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারপর রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে সেদেশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন। গতকাল সোমবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ। সংবাদ সম্মেলনে এবার ফানুস উত্সব না করে উত্সবে ব্যয়ের টাকা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুড্ডিস্টসহ বিশ্ব সমপ্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ জীবন দাবি করি।’ বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমার দূতাবাসের অনুমতি পেলে তারা এই কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে জানান শুদ্ধানন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের মুখ্য সমন্বয়ক অশোক বড়ুয়া বলেন, তিথি অনুযায়ী আগামী ৫ অক্টোবর এবারের প্রবারণা পূর্ণিমা হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে এবার তা উদযাপন করছি না আমরা।’
কুতুপালংয়ে চসিক মেডিকেল টিম
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অসহায় অসুস্থ রোহিঙ্গা নারী-শিশু-বৃদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে পাঁচ লাখ টাকার ওষুধসহ উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে রওনা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি মেডিক্যাল টীম। গতকাল সোমবার সকালে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নির্দেশে মেডিকেল টিমটি উখিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে বলে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আরো ৩ রাহিঙ্গা
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের নিযুক্ত সশস্ত্র ব্যক্তিদের গুলি ও মাইন বিস্ফোরণে আঘাতপ্রাপ্ত আরও ৩ রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।