কোন একটি ঘটনা যখন আংশিক ভাবে বলা হয় তখন সে ঘটানাটির প্রকৃত চরিত্রটা বোঝা যায় না। ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভিসি স্যার কে গালিগালাজ, ধাক্কা দিয়েছিল। আমরা ভিসি স্যার উদ্ধার করেছি, কোন রকম হামলা করিনি আন্দোলনকারীদের উপর। বরং উল্টা আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীরা আহত হয়েছে তাদের হামলায়। এখন বক্তব্য হচ্ছে, ভিসি স্যারকে খারাপ মন্তব্য করা সমগ্র ঘটনার ছোট্ট একটি অংশ মাত্র। পুরো ঘটনাটি কিংবা ভিসি স্যার এর সাথে অসম্মানীয় আচরণ করার কারণ কি তা না জানলে বলা যাবে না কারা কাদের উপর হামলা করেছে বা অসম্মান করেছে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলন করছে, আন্দোলন করা মানি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দাবি মেনে নিতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু কি বিষয়ে আন্দোলন করছে সে বিষয়েও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকেও একটু গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কতটা যুক্তিযুক্ত তা সবার সাথে বসে বিষয়টি একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।
১৫ তারিখের পর থেকে সর্বশেষ ঘটনার যে আন্দোলন সেটির শুরু কিন্তু গতকাল ছিল না। শুরুটা গত ১৫ তারিখে। সেদিন কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ে কিছু ঘটনা ঘটেছি। সেই ঘটনাটার সর্বশেষ অংশটাই ছিল গত পরশু দিনের সংঘর্ষ। সেদিন ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ওই আন্দোলনের সমন্বয়কারীকে ভিসির রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছিল। যে ঘটনাটা ঘটেছিল প্রক্টরের সামনে। কিন্তু প্রক্টর ওই সমন্বয়কারীকে রক্ষা করেননি ছাত্রলীগের হাত থেকে। এছাড়া সেদিন আরও ভয়ংকর ঘটনাও ঘটেছিলো। ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করেছিলো। এবং সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, ফটোসহ অনেক গুলো প্রত্যক্ষদর্শীর আলোচনা-সমালোচনা ইতোমধ্যে মিডিয়াগুলোতে প্রচার হয়েছে। এই বিষয়গুলো যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সামনে আনা হয় তখন কর্তৃপক্ষ দুটো কথা বলেন, একটা আইনগত পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা নিবেন অন্যটা হচ্ছে এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি করবেন। এই ঘটনার যে প্রমাণ আছে সে বিষয়গুলো যখন তুলে ধরা হয় তখন বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন যৌন নিপীড়ন বিরোধীদের ক্ষেত্রে বলেন, পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এরই মধ্যে অজ্ঞাত ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছেন প্রক্টর। যারা যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন করেছিলো, যারা যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়েছিলো। অথচ এরাই প্রক্টরের কাছে গিয়েছিল যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আর প্রক্টর ব্যবস্থা নিল প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে! গতপরশুদিনের যে ঘটনা তা ওই ঘটনার একটি রেশ।
এখন ছাত্রলীগ, ভিসি ও প্রক্টর বলছে আন্দোলনকারীরা সন্ত্রাসী, বিশ^বিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্টকারী, ভিসিকে অসম্মানকারী। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এই রকম ঘটনা গতকাল কিন্তু প্রথম ঘটেনি। এর আগেও অনেক ঘটেছে। ২০০৫ সালে যখন ছাত্রলীগ তাদের দাবিতে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তখন ভিসিকে অসম্মান করেছে বলে ছাত্রদল গতকালকের ঘটনার মতোই ওই আন্দোলনকারীদের হামলা করে বের করে দিয়েছিলো।
আমরা যদি যুক্তিতে আসি তাহলে বলা যায়, এই যে এই ঘটনাটি কেন ঘটেছিল তার আগে শিক্ষার্থীরা কি চেয়েছিলো? ভিসির সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। শিক্ষার্থীরা ভিসির সাথে কথা বলতে চাইলে তাদের তিনটি তালা ভাঙতে হলো কেন? তিনটি তালা ভাঙার আগে ভিসি তাদের সাথে কথা না বলে বের হয়ে যেতে হলো কেন? তারা তো বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তালা ভাঙার আগে ভিসি তাদের সামনে আসতে পারতেন, বসতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন, সব কিছু যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তখন আন্দোলনকারীরা এই বিষয় না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু তা তো করা হয়নি।
এখন বলা হচ্ছে ভিসিকে অসম্মান করা হয়েছে। কিন্তু কেন ভিসিকে অসম্মান করা হয়েছে? এই প্রশ্নটাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটা ঘটনা যখন ঘটে তখন ওই ঘটনার পেছনে একটি বা একাদিক কারণ থাকে সেটা আমরা সবাই জানি। ভিসিকে অসম্মান করেছে এই ঘটনার পেছনেও কিন্তু অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন, আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে, আন্দোলনের সমন্বয়কারীকে ভিসির রুমে নিয়ে গিয়ে ছাত্রলীগ মারধর করেছে, নারী শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন (প্রক্টর, ভিসি) তখনও আটকায়নি হামলাকারীদের, আবার যৌন নিপীড়ন বিরোধীদের নামেই উল্টা মামলা করেছেন। এই সব কারণেই হয়তো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ভিসিকে গালাগাল করেছে। সেটি দেখার জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন আছে, বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। কিন্তু এই ছাত্রলীগ কেন ভিসিকে রক্ষা করার জন্য যাবে? ছাত্রলীগ তো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বে নেই বা তারা বিশ^বিদ্যালযের লাঠিয়াল বাহিনী না। এখন প্রশ্ন হলো এরকম একটি ঘটনা সামলানোর জন্য ছাত্রলীগ কে কেন ডাকা হলো? ছাত্রলীগ কে কেন ডাকা হলো তার কারণ হচ্ছে, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন হল সহ সমগ্র জায়গার দায়িত্ব ছাত্রলীগকে ছেড়ে দিয়েছে। সে জন্য ছাত্রলীগকে ডাকা হয়েছে। এটা কিন্তু এই ঘটনায় নতুন ঘটেনি। এর আগেও বিএনপি সকরকার থাকাকালীন ঠিক এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ সালে দেখা গেছে ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছে। ছাত্রদল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছে। তখনও কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা ভয় পায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল। কিংবা এর আগে আইয়ুব খান আমলে দেখা গেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভয় দেখাতো প্রশাসন, সেই ভয় দেখানোর সংস্কৃতি এখনো রয়েগেছে। এখনও ঠিক একই ভাবে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর ছাত্রলীগ কে দিয়ে ছাত্রদের পেটাচ্ছে। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ ভিসিকে রক্ষা করার নামে ছাত্রদের পেটাচ্ছে, নারীদেরকে লাথি, ঘুষি, যৌন নিপীড়ন করছে, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে এর ভিত্তিতে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের একটু লজ্জা পাওয়া উচিত। জাতি হিসেবে, একজন সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি কিংবা দেশের পুরো জাতি লজ্জা পাচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন ছাত্রলীগকে ডেকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের যে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন করিয়েছেন তাতে বিশ^বিদ্যায় প্রশাসন, ভিসি ও প্রক্টরের লজ্জা পাওয়া উচিত। ওনাকে জাতির সামনে এসে জবাব দেওয়া উচিত, ঠিক কি কারণে ঘটনাগুলোর জন্ম দিয়েছেন?
লেখক: শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম।