ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন ও জনসংখ্যা বাড়ছে। এ দুই সিটি করপোরেশন-সংলগ্ন ও আশপাশের ১৭টি ইউনিয়ন যুক্ত হচ্ছে সিটি করপোরেশনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরের এই সম্প্রসারণের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে সম্প্রসারিত এলাকার নকশা তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত ১৭টি ইউনিয়ন হচ্ছে সুলতানগঞ্জ, ডেমরা, দনিয়া, দক্ষিণগাঁও, উত্তরখান, দক্ষিণখান, নাসিরাবাদ, হরিরামপুর, ডুমনি, বাড্ডা, বেরাইদ, মাতুয়াইল, মাণ্ডা, ভাটারা, শ্যামপুর, সাঁতারকুল ও সারুলিয়া। দীর্ঘদিন ধরে এসব ইউনিয়নের বাসিন্দারা নগরের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও কাগজে-কলমে গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতেন। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যাতে এসব ইউনিয়নে ভোট না হয়, সেই প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারসচিব আবদুল মালেক বলেন, হরিরামপুর থেকে দনিয়া পর্যন্ত এলাকাটি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই আলোকে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) পরবর্তী সভায় এ বিষয়টি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে।
এর আগে গত ৭ অক্টোবর সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও সাতটি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকা জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে ১৭টি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই আলোকে নকশাও তৈরি করা হয়েছে।
নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ওই ইউনিয়নগুলো রাজউকের কাছে শহুরে, বিবিএসের কাছে শহুরে, কিন্তু আসলে গ্রামীণ চরিত্র নিয়ে আছে। তাঁর মতে, শহুরে আবহের ভেতর গ্রামীণ চরিত্রে থাকা মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই সিটি করপোরেশন এটা নিয়ে নিতে পারে, অথবা আলাদা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা গঠন হতে পারে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, সামগ্রিক ঢাকার আয়তন বাড়ানো নিয়ে বিভিন্ন রকম হিসাব-নিকাশ রয়েছে। পূর্বাচল ও ঝিলমিল সম্প্রসারিত ঢাকায় পড়বে কি না, সেই আলোচনা আছে। এগুলো নিয়ে রাজউকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু ঢাকা জেলা প্রশাসন এই মুহূর্তে ১৭টি ইউনিয়ন দুই সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করার আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় এটা চূড়ান্ত করবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকার সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। তবে স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও এমন কোনো আইন হয়নি। ফলে নির্ধারণ করা যায়নি রাজধানীর সীমানাও। একেক সংস্থা একেকভাবে এর সীমানা ধরে নিচ্ছে। এতে রাজধানীকে নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পর রাজধানী ঢাকার সংজ্ঞা নির্ধারণ না হওয়াটা দুঃখজনক। ঢাকার কতটুকু আসলে রাজধানী, তার উত্তর কারও জানা নেই। সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও এ-সংক্রান্ত কোনো আইন করা হয়নি। বিষয়টি কিছুদিন আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আদমশুমারি বলছে, ঢাকার আয়তন ১ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধিভুক্ত ঢাকার আয়তন আবার ১ হাজার ৬৮৩ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু সিটি করপোরেশনের হিসাবে ঢাকা এখনো অনেক ছোট। কামরাঙ্গীরচরের কয়েকটি ইউনিয়ন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩৮০ বর্গকিলোমিটার।
১৭টি ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত হলে দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন কতটা বাড়বে এবং কোন ইউনিয়ন কোন সিটি করপোরেশনের আওতায় পড়বে, তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এ নিয়ে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, যা থেকে সরকার একটি চূড়ান্ত করবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই সব ইউনিয়নের বাসিন্দারা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু কিছুসংখ্যক জনপ্রতিনিধি এটা চায় না। তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশে ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে এই বিশাল এলাকা থাকায় সেখানে ১০ তলা ভবন হচ্ছে বা পরিকল্পনাহীন আবাসন হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন নিয়ে। সেখানকার নাগরিকদের অনেকে শহরের সুবিধা পেলেও কর দিচ্ছেন না বা খুব কম কর দিচ্ছেন।
রাজধানী ও আশপাশের জেলার যানজট নিরসনে ১০ বছর আগে প্রণয়ন করা হয় কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। আর ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১০ সালে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করে রাজউক। এ দুই মহাপরিকল্পনায় ঢাকার আয়তন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। ফলে ড্যাপ ও এসটিপির মধ্যে কখনোই সমন্বয় করা যায়নি।
ড্যাপে ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নারায়ণগঞ্জ ও সাভার। আর এসটিপিতে ঢাকা বলতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ—এই পাঁচটি জেলাকে বিবেচনা করা হয়েছে। এর সঙ্গে নরসিংদীর আংশিকও ঢাকার অন্তর্ভুক্ত। পুরো এলাকা বৃহত্তর ঢাকা বলে এসটিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর পূর্ববর্তী ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন আইন অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর ২০১১ থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়, যা কার্যকর হয় ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ওই ১৭টি ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে।