ছৈয়দ মনির আহাম্মদ
ডাইনোসরের রেখে যাওয়া বিভিন্ন সুত্র থেকে আমরা তাদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি। মানুষ ডাইনোসরের হাড়, দাঁত, পায়ের ছাপ, ডিম এবং বাসার ফসিল আবিষ্কার করেছে। এসব তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের আকার, আকৃতি এবং জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। মানুষ এখনও এদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন কোনো কিছু আবিষ্কার হলে আগের ধারণা পরিবতর্তিত হয়।
বহু আকার ও আকৃতির ডাইনোসর ছিল। কিছু কিছু ছিল বিশাল আকারের। অন্যগুলো ছিল বড় পাখির মতো। কোনো কোনটি চার পায়ে হাঁটত। আবার কোনোটিবা পেছনের পায়ে ভর করে হাঁটত বা দৌড়াত। হিংস্র মাংসাশী ডাইনোসর যেমন ছিল তেমনি ছিল নিরীহ তৃণভোজীৗ। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, ডাইনোসররা সরীসৃপ ছিল। তাই তাদের ত্বকে ছিল আঁশ। তারা ডিম পাড়ত।
বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের কোমরের হাড়ের উপর ভিত্তি করে এদের দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। কোমরের হাড় সামনের দিকে সোজা তাক করা থাকলে তাকে বলা হয়েছে ‘লিজার্ড হিপ’। আর পেছনের দিকে তাক করা থাকলে তা ‘বার্ড হিপ’। চামড়ার ছাপ থেকে বোঝা যায় ডাইনোসরের বিভিন্ন প্রকারের চামড়া ছিল। কোনো কোনোটির ছিল বড় বড় আঁশ। আবার কোনোটির ছিল ছোট মসৃণ আঁশ। এদের আঁশের রঙ কী করম ছিল তা শুধুমাত্র অনুমানই করা যায়। হতে পারে তারা বর্তমানের সরীসৃপের মতো বর্ণের ছিল।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে মহাদেশগুলো এক সাথে একটি ভূখন্ডের অর্ন্তগত ছিল। এই পুরো ভূমি জুড়ে ডাইনোসর বাস করত। প্রত্যেক মহাদেশেই এদের হাড় পাওয়া গেছে। এ থেকেই এমনটি অনুমান করা হয়। বিভিন্ন ডাইনোসরের বহু হাড় মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে।
এখনকার সরীসৃপের মতোই ডাইনোসর ডিম পাড়ত। উত্তর আমেরিকায় পাওয়া গেছে ডাইনোসরের বাসার ফসিল। তাতে ডিমও পাওয়া গেছে। এমন কয়েকটি বাসা পাওয়া গেছে খুবই কাছাকাছি অবস্থানে। সম্ভবত নিরাপত্তার জন্য মায়েরা দল বেঁধে বাচ্চাকে পাহাড়া দিত। মাইয়াসরা ডাইনোসরের বড় ছোট এবং শিশুর হাড় পাওয়া গেছে একটি স্থানে। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে পরিবারগুলো একসাথে বাস করত।
কিছু কিছু ডাইনোসর পরিণত বয়সে বড় বড় দলে বাস করত। এই দলকে বলা হতো পাল। পালের ভেতর একটি ডাইনোসর অন্য ডাইনোসরকে নিরাপত্তা দিত। ডাইনোসর ঠিক কত বছর বেঁচে থাকত তা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা কিছু কিছু ডাইনোসর ২০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল। তবে অনকেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আহত হয়ে বা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
ডাইনোসর সাঁতরে নদী পার হতে পারত। কিন্তু শুকনো মাটিতে তারা খেত, ঘুমাত এবং বাচ্চা লালনপালন করত। পায়ের ছাপের ফসিল থেকে বোঝা যায় কীভাবে ডাইনোসর চলাচল করত। এর সাহায্যে এও জানা যায় ডাইনোসর একা চলাফেরা করত নাকি দল বেঁধে চলত। তারা কত দ্রুত চলত তাও বের করা যায়। এমন পদচিহ্ন বিশ্বের সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
কিছু কিছু ডাইনোসর ছিল উদ্ভিদভোজী। এরা শুধু উদ্ভিদই খেত। অন্যরা ছিল মাংসাশী। তারা খেত মাংস। অনেক উদ্ভিদভোজীরই খাবার ছিল পাতা, কান্ড এবং মূল। মাংসাশী ডাইনোসররা নিরীহ উদ্ভিদভোজীদের প্রায়ই আক্রমণ করত। এদের ছিল বড় শক্ত চোয়াল এবং ধারালো দাঁত।
কিছু উদ্ভিদভোজী ছিল খুবই ক্ষিপ্র। দ্রুত চলাচল করতে পারত। সহজেই তারা শত্র“ থেকে বেঁচে যেতে পারত। কেউ কেউ আবার চলাফেরা করত বেশ ধীর গতিতে। এদের শরীরে আবার শক্ত সুরক্ষা ছিল। শরীরের শক্ত খোলস ধারালো কাঁটা এবং শিঙ শত্র“ থেকে তাদের সুরক্ষা দিত। মাংসাশীরা সব সময় লোভনীয় খাবার খুঁজে বেড়াত। তাই উদ্ভিদভোজীদের হয় দ্রুত পালাতে হবে অথবা যুদ্ধ করতে হবে।
সব রকমের কোলাহল ডাইনোসর করত। বিশেষত ডাকবিলড বা হংসপঞ্চু ডাইনোসর খুবই কোলাহলপ্রিয় ছিল। তারা নাক দিয়ে শব্দ করত। সম্ভবত তার সাহায্যে তারা সঙ্গীকে কাছে ডাকত বা শত্র“কে সাবধান করত।
ধারণা করা হয় ডাইনোসর বোকা ছিল। কারণ এদের মাথার খুলি ছিল খুবই ছোট। এতে মগজ ধরত খুবই কম। এতবড় প্রাণী কীভাবে বেশিদিন টিকে ছিল বিজ্ঞানীরা তাই ভেবে অবাক। সম্ভবত আমরা যা ভাবী তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছিল এরা।
এখনকার সরাীসৃপগুলো শীতল রক্তবিশিষ্ট। ডাইনোসরও ছিল সরীসৃপ। তাই তারাও কি শীতল রক্তবিশিষ্ট ছিল? বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। শীতল রক্তের প্রাণীরা শরীর উত্তপ্ত করতে পারে না। আবহাওয়া উষ্ণ হলে তারাও উষ্ণ এবং কর্মক্ষত তাকে। আর যদি আবহাওয়া শীতল থাকে তারাও শীতল এবং গতিহীন থাকে। উষ্ণ রক্তের প্রাণীরা উষ্ণ থাকে। কারণ তারা শরীর উত্তপ্ত করতে পারে।
পৃথিবী অনেক অনেক পুরানো। পৃথিবীর প্রথম উদ্ভিদ এবং প্রাণী ছিল সমুদ্রের ছোট ছোট কোষ। এসব কোষ হতে গড়ে উঠল বড় উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা। এটাকে বিবর্তন বলে। প্রথম ডাইনোসরের আবির্ভাব হয়েছিল ২৩ কোটি বছর আগে। সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম উদ্ভিদ এবং প্রাণী বাস করত সমুদ্রে। শুরুতে এরা খুবই ছোট ছিল। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এদের দেখা যেত না। প্রথম হাড়যুক্ত প্রাণী ছিল মাছ। ডাইনোসর এবং মানুষসহ অন্যান্য হাড়যুক্ত প্রাণীদের বিবর্তন হয়েছিল স্থলভাগে।
৩৮ কোটি বছর আগে কিছু মাছ পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে আসে। এরা হয়ে উঠল উভচর প্রাণী। তারা স্থলে বাস করত। কিন্তু ডিম পাড়ার জন্য পানিতে যেতে হতো। উভচর প্রাণীর পর এলো সরীসৃপ। এরা স্থলভাগেই ডিম পাড়তে পারত। ডাইনোসর ছির সরীসৃপ।
কিছু সরীসৃপ খাবারের সন্ধানে ফিরে গেলে সমুদ্রে। এই সমুদ্র- সরীসৃপগুলো ডাইনোসরেরই সমসাময়িক ছিল। এদের মধ্যে কিছু ছিল নথোসরাস। এরা স্থল এবং সমুদ্র দু’ জায়গাতেই বাস করতে পারত। এদের পা ছিল সম্ভবত প্যাডেলের মতো। আঙুলগুলো পাতলা চামড়া দিয়ে যুক্ত ছিল। বেলাভূমিতে হাঁটতে কাজেও এই পাগুলো উপযোগী ছিল। ইকথিওসরাসের মতো কিছু সরীসৃপ দলবদ্ধভাবে সামুদ্রিক খাবার খেত।
কিছু সরীসৃপ ২৫ কোটি বছর আগে ওড়া শুরু করেছিল। প্রথমদিকে তারা শুধুমাত্র গ্লাইডার। একটি গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারত শুধু। প্রথম সার্থকভাবে যে সরীসৃপটি উড়তে পেরেছিল তার নাম টেরোসর। এর প্রতিটি পাখা ছিল পাতলা চামড়ায় গড়া। একটি বেশ লম্বা আঙুল বরাবর এই পাখা বিস্তৃত ছিল। টেরোসর ছিল উষ্ণ রক্তের প্রাণী। তাদের শরীর এবং পাখা ছিল ছোট ছোট লোমে ঢাকা। ঠিক এখনকার বাদুরের মতো।
জার্মানির এক খনিতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে একটি পাখির পালকের ফসিল পাওয়া যায়। এর এক বছর পর পাওয়া গেছে একটি পুরো কঙ্কাল। তার পাখা ও লেজে পালক ছিল। এটি ১৫ কোটি বছরের পুরানো। অর্থাৎ সে বাস করত ডাইনোসরদের যুগে। এই প্রথম পাখিটির নাম দেওয়া হয়েছে আররিওপটেরিক্স। এর অর্থ হচ্ছে প্রাচীন ডানা।
পৃথিবীতে ডাইনোসর বেঁচেছিল ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছর। এর সময়টাকে বলা হয় মেসোজোয়িক যুগ। এ সময়ের পরের কোনো ডাইনোসরের ডাড় পাওয়া যায়নি। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেল। এর অর্থ হলো পৃথিবী থেকে এরা চিরতরে হারিয়ে গেল। কিন্তু এদের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ কী? ইতিহাস সময়কে যে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে তাদের বলা হয় যুগ। ডাইনোসর বাস করত মেসোজোয়িক যুগে। মেসোজোয়িক যুগকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ট্রায়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রিটেসাস যুগ। প্রত্যেক যুগেই বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসর বাস করত। কিন্তু মেসোজোয়িক যুগ শেষ হওয়ার পর কোনো ডাইনোসর ছিল না।
স্তন্যপায়রা উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। তাদের শরীরে পশম আছে। প্রথম স্তন্যপায়ীরা ডাইনোসরের সাথে পাশাপাশি বাস করত। কিন্তু মেসোজোয়িক যুগ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তারা হারিয়ে যায়নি। তারা এখনও টিকে আছে। ডাইনোসরের পর স্তন্যপায়রা প্রভাবশালী হয়ে গেল। প্রথম দিকের স্তন্যপায়ী ছিল ছোট। বড় স্তন্যপায়ীর উদ্ভব হয়েছিল আরও পরে।
ডাইনোসর সম্পর্কে আমরা জেনেছি ২০০ বছরেরও কম সময় আগে। এর আগে বড় বড় হাড় পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ ভেবেছে তা ড্রাগন বা দনবের হাড় হতে পারে। আস্তে আস্তে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন এগুলো ছিল এমন কতগুলো প্রাণীর যারা দীর্ঘদিন আগে এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাড়গুলো ক্রমান্বয়ে পাথরে পরিণত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফসিলে রূপ নিয়েছে।
ডাইনোসরের হাড় গবেষণা করার জন্য ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজ্ঞানীরা খুবই সতর্কতার সাথে হাড় পরিষ্কার করেন। খেয়াল রাখেন যাতে নষ্ট না হয়। এগুলো করতে কখনও কখনও কয়েক বছরও লেগে যায়। পর্যাপ্ত হাড় পাওয়া গেলে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসর বানানো হয়। এটি একটি বিশাল ও জটিল জিগস পাজল সংযুক্ত করারই মতো।
সূত্র- ছোটদের বিজ্ঞানপিডিয়া-৬
আলী ইমাম