১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ট্রাম্পের আমেরিকা কি আবার এশিয়ায় ফিরবে

বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকার রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর আধিপত্য ও বিশ্বসেরা প্রতিরক্ষা বাহিনী। কেউ ভালোবাসুক বা ঘৃণা করুক, আমেরিকার সফট পাওয়ার এবং হার্ড পাওয়ার বর্তমান বিশ্বে অনেক বেশি প্রয়োজন।
এমনই প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল বিজয় বিশ্বব্যাপী অভিবাসন, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বদলে যাওয়ায় ট্রাম্প এশিয়া অঞ্চলে মিত্র ও অংশীদারদের এবং প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কি এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আবারও ফিরবে আমেরিকা?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘দ্বিতীয় ট্রাম্প’ বিশ্বব্যাপী গভীর প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় শাসনামলে প্রশাসন বিধিনিষেধ ও শুল্ক আরোপ করার সম্ভাবনা থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একটি বাণিজ্য যুদ্ধে প্রবেশ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, ট্রাম্প ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির জন্য চাপ দিতে পারেন। তবে তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরের সংঘাত ইস্যুতে ট্রাম্প কেমন অবস্থান নেবেন তা এখনো অনিশ্চিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা স্বল্পমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন পদক্ষেপের ওপর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কম পড়বে।
ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টারা জানেন চীন কোথায় অবস্থিত। কিন্তু এর অদূরেই বার্মা (বা মিয়ানমার) নামে একটি দেশ রয়েছে (মার্কিন সরকার এখনো এই দেশটিকে বার্মা বলেই ডাকে)। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে ধারণা করা হচ্ছে, এ অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের লক্ষ্য নেই। তাই মিয়ানমারের প্রতি তাদের কোনো স্বার্থ থাকবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পেরপানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের
তবে দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদের কারণে সম্ভবত ট্রাম্প প্রশাসন মিয়ানমারের প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারে, যা মূলত চীনে রপ্তানি করা হয়।
মিয়ানমারের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার শুরুটা ১৯৮৮ সালে। সে বছর দেশটিতে তীব্র গণঅভ্যুত্থান দমনে সামরিক বাহিনী নির্মম নির্যাতন শুরু করে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চির দিকে মনোযোগ দেয় এবং দেশটিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং ফার্স্ট লেডি লরা বুশ মিয়ানমারের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি ‘পিভট টু এশিয়া (এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ) নীতি চালু করেছিলেন। তিনি ২০১২ ও ২০১৪ সালে দু’বার মিয়ানমার সফর করে সময়ের আগেই দেশটি থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন।
বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এছাড়া দেশটির জান্তা সরকার রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে জোট গঠন করেছে (অতীতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এবং সম্প্রতি ইরানের সাথে এটি করার পরে)। মূলত তারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিশালী আমেরিকান নেতৃত্ব দেখতে চায় না। ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে এবার নিঃসন্দেহে মিয়ানমারের সক্রিয় কর্মী ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা নতুন মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে। মিয়ানমারের প্রতি মার্কিন প্রশাসনকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিরতা বিরাজ করছে; যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে জান্তার ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে মিয়ানমারের জনগণকে সমর্থনের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০২২ সালে বার্মা অ্যাক্ট পাস করেছে। তবে, এটি এখনো বাস্তবায়নের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
যেহেতু মিয়ানমার নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির আগ্রহ কম, বিশেষ করে স্টেট ডিপার্টমেন্টে; তাই ধারণা করা হচ্ছে, দেশটিতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ সাধারণত কম থাকবে।
যোগ্যতা না থাকলেও উপপরিচালক পদে বসতে চান মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাযোগ্যতা না থাকলেও উপপরিচালক পদে বসতে চান মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে চীন মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার ভূকৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নেবে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ভৌগোলিক সম্পর্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ও অবকাঠামো পরিকল্পনা বেইজিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বে মার্কিন স্বার্থ মোকাবিলায় চীন তার সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা জোরদার করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, মিয়ানমারের জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং সমর্থন দেখতে চায়। তাদের বিশাল প্রতিবেশী চীনকে মোকাবিলার জন্য, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শক্তির (এবং ভবিষ্যতের বেসামরিক সরকারগুলোর) নিঃসন্দেহে মার্কিন নেতৃত্ব এবং এশিয়া অঞ্চলের সমমনা দেশগুলোর প্রয়োজন হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে সিনেটর মার্কো রুবিওকে। ধারণা করা হচ্ছে, তার পররাষ্ট্রনীতি চীনের প্রতি আগ্রাসী হবে। এ লক্ষ্যে রুবিও মিয়ানমারের প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারেন, যদি তিনি দেখাতে চান- তিনি মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি একজন কঠোর মানুষ। তার উচিত মিয়ানমারের জনগণের পক্ষে কথা বলা।
দিলজিৎ দোসাঞ্জ ও এপি ধিলনের দ্বন্দ্বের নতুন মোড়দিলজিৎ দোসাঞ্জ ও এপি ধিলনের দ্বন্দ্বের নতুন মোড়
তার নেতৃত্ব প্রদর্শনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। তবে কি তিনি মিয়ানমার নিয়ে ওবামার ত্রুটিপূর্ণ নীতির বাইরে যাবেন এবং এশিয়ার পাশাপাশি কিউবার দিকে ঝুঁকবেন?
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি প্রকাশের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নিতে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি পৃথিবীর দ্রুততম ক্রমবর্ধমান, বিশ্বব্যাপী জিডিপির ৬০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন, ট্রাম্পের এ স্লোগানকে প্রতিষ্ঠিত করা হলে মনে রাখা উচিত, আমেরিকা আবার ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, জান্তার অধীনে মিয়ানমার মুক্ত ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে- এটি যেন ভুলে যাওয়া সংকটে পরিণত না হয়।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ সংবাদ