ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিভিন্ন দেশের সরকার জ্বালানি সংকট কাটাতে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে এবং অনেক সময় ও সম্পদ ব্যয় করছে। কিন্তু যুদ্ধ আরও বড় একটি সংকটের বীজ বপন করেছে যা একই ধরনের মনোযোগ পাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের কারণে খাদ্যের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব দুর্ভিক্ষ ও ঋণ সংকটের হুমকির মধ্যে পড়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরও গভীর করছে। ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। তারা বিশ্বের গম রপ্তানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা বলছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জমি ২০২২ সালের মৌসুমে অনাবাদি বা চাষের আওতার বাইরে থেকে যাবে। সম্প্রতি জি-৭ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইউক্রেনের বন্দর রাশিয়া দ্বারা অবরুদ্ধ থাকা এবং খাদ্যশস্য রপ্তানি আটকে থাকার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। যদিও রাশিয়ান কৃষকরা এখনও উৎপাদন করতে পারছেন। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম সার রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া মার্চের শুরুতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। বেলারুশ থেকে করা রপ্তানি, নামমাত্র রাশিয়ার সাথে জোটবদ্ধ থাকলেও তাদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চীনও গত গ্রীষ্মে সার রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে এখন বিশ্বব্যাপী সারের ঘাটতিও দেখা দিয়েছে। দামও লাফিয়ে বাড়ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে।
এফএও-র খাদ্য মূল্যসূচক অনুসারে, গত এপ্রিলে খাদ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি এই সংকটে পড়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মোট পরিবারের ব্যয়ের অন্তত অর্ধেক খাদ্য ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ এবং অনেক দেশেই সরকার খাদ্য ভর্তুকি প্রদান করে। এগুলোর ব্যবস্থাপনা বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ খরচ এবং খাদ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রতি শতাংশ খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী ১ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ইতোমধ্যেই সামাজিক অস্থিরতা ও ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া এবং পেরুতে খাদ্য ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়ছে। গত এপ্রিল মাসে প্রায় ১ কোটি ব্রিটিশ নাগরিক খাদ্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে এবং ফ্রান্স দরিদ্র পরিবারগুলোতে খাদ্য ভাউচার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যের বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতির ফলে তা মার্কিন প্রচারাভিযানের ইস্যু হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এটি একটি পরিবর্তন আনতে পারে।
অর্থনীতিবিদ অ্যালান ব্লাইন্ডার ও জেরেমি রুড যুক্তি দেন যে, ৭০’এর দশকের অস্থিরতা জ্বালানি এবং খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে হয়েছিল। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা সংকট নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের ভাবা দরকার। স্থানীয় সরবরাহ রক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি দেশ দ্বারা আরোপিত বাণিজ্য বিধিনিষেধের প্রভাবও খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করছে। রাশিয়ার সূর্যমুখী তেলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে গত এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। গত সপ্তাহে ভারতও গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা ঐতিহাসিকভাবে বেহাল এবং কখনো কখনো বিপরীতমুখী হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্য সহায়তা প্রদানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নগদ অর্থ নয় বরং আমেরিকান-উৎপাদিত খাদ্যের বেশি প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরবরাহের অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব খরচে হওয়া দরকার। সম্প্রতি আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য অনুমোদিত একটি খাদ্য সহায়তা বিলে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৮২ মিলিয়ন ডলারের খাদ্য পণ্য পরিবহনে ৩৮৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে।
অর্থনীতিবিদ ও খাদ্য সহায়তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, শুধু খাদ্য মজুত না করে নগদ অর্থ এবং দক্ষতার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। কৃষকদের তাদের জলবায়ু ও মাটির অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে স্থানীয়ভাবে ফসল উৎপাদনে সাহায্য করা অনেক কম ব্যয়বহুল এবং অনেক বেশি কার্যকর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইইউ, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের মতো খাদ্য ও সার রপ্তানিকারকদের বাণিজ্য বিধিনিষেধ আরোপ না করার বিষয়ে সম্মত হওয়া উচিত এবং ভারতের উচিত তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য বের করার উপায়গুলো জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবেচনা করা উচিত। চীন সারের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে এবং ভুট্টা, চাল ও গমের মজুত হ্রাস করে অবদান রাখবে এই সম্ভাবনা ক্ষীণ।